মোটরসাইকেল রাইডারদের জন্য সার্টিফাইড হেলমেট ও তার বিস্তারিত
This page was last updated on 28-Jun-2025 01:13pm , By Badhan Roy
মোটরসাইকেল রাইডারদের জন্য সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক্সেসরিজ বা গিয়ার হিসেবে হেলমেট অপরিহার্য। আপনি কি জানেন, একটি সার্টিফাইড হেলমেট দূর্ঘটনায় মাথায় আঘাতের ঝুঁকি ৬৯% এবং মৃত্যুর ঝুঁকি ৪২% পর্যন্ত হ্রাস করে থাকে। তাই ভালোমানের হেলমেট ব্যবহার সব রা্ডারদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। আর সেইসূত্রে আজ আমরা মোটরসাইকেল রাইডারদের জন্য সার্টিফাইড হেলমেট ও তার বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানবো।

মোটরসাইকেল রাইডারদের জন্য সার্টিফাইড হেলমেট ও তার বিস্তারিত
মোটরসাইকেল রাইডারদের শুধুমাত্র কঠোর আইনের প্রয়োগ বা জরিমানার হাত থেকে নয় বরং অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনায় মানবদেহের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ মাথার আঘাত থেকে বাঁচার জন্য ভাল মানের হেলমেট ব্যাবহার অত্যান্ত জরুরি। একটা সময় ছিল বাইকাররা হেলমেট ব্যাবহারের ক্ষেত্রে উদাসীন ছিলেন যা এখনো অনেকের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু ইতিবাচক ব্যাপার হচ্ছে দিন দিন বাইকাররা হেলমেটের ব্যাপারে সচেতন হচ্ছেন এবং সার্টিফাইড হেলমেট ব্যাবহারে উৎসাহী হচ্ছেন। আর আমরাও বাইকারদের বরাবরই নিম্নমানের হেলমেট পরিহার করে সার্টিফাইড হেলমেট ব্যাবহারের পরামর্শ এবং উৎসাহ দিয়ে থাকি। তো আজ আমরা সার্টিফাইড হেলমেটের ইতিহাস, বিবর্তন, হেলমেট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সঠিক মাপ নির্ধারণ এবং কোন ধরনের রাইডারের জন্য কোন টাইপের হেলমেট উপযোগী তা নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা করব।

মোটরসাইকেল হেলমেটের ইতিহাস
১৯ শতকের শুরুর দিকে মোটরসাইকেল জনপ্রিয় হতে থাকে। যদিও শুরুতে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা হেলমেট ব্যাবহারের প্রচলন ছিল না। ১৯১৪ সালের দিকে ব্রিটিশ চিকিৎসক ডাক্তার এরিক গার্ডনার লক্ষ্য করেছিলেন যে তাকে প্রতি দুই সপ্তাহে অন্ততঃ একজন করে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত মোটরসাইকেল চালকের চিকিৎসা করতে হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে তিনি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং এর প্রতিকারের জন্য কর্ক, ক্যানভাস এবং লাক্ষা দিয়ে একটি হেলমেট প্রস্তুত করে অটো সাইকেল ইউনিয়নের কাছে উপস্থাপন করেন। যদিও প্রথমে তার তৈরীকৃত এই হেলমেটটি খারিজ করা হয় এবং মোটরসাইকেল চালকগণ হেলমেট ব্যাবহারের তীব্র বিরোধীতা করেন, তারপরেও ডাঃ এরিকের অনুরোধে জনপ্রিয় টিটি আইল অফ ম্যান রেসিং কতৃপক্ষ রেস চলাকালে হেলমেট ব্যাবহার বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেন।

রেস শেষে কতৃপক্ষ এবং ইভেন্টের মেডিকেল অফিসার তাকে ধন্যবাদ দিয়ে আলাদা আলাদা চিঠি পাঠান এবং তাতে উল্লেখ করেন প্রতিবছর অনেক রেসার দূর্ঘটনায় মারাত্মক আহত এবং নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও শুধুমাত্র হেলমেট ব্যাবহারের কারনে সেবছর রেস চলাকালে দূর্ঘটনায় কোন রেসারের আশংকাজনক আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এভাবেই হেলমেট ব্যাবহার ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়।
১৯৩৫ সালের মে মাসে ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা টমাস এডওয়ার্ড লরেন্সের সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকে হেলমেট বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাবহার করার জন্য সর্বপ্রথম আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৫০ এর দশক থেকে হেলমেট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয় এবং সর্বপ্রথম ক্রাশ হেলমেট কোম্পানি বাজারে মোটরসাইকেল সেফটি হেলমেট নিয়ে আসে। ধীরে ধীরে ক্রোমওয়েল ও বেল হেলমেট বাজারে বেশ ভাল সাড়া ফেলে এবং বেল ৫০০ মডেলের হেলমেট কে বর্তমান হেলমেটের পূর্বসুরি হিসেবে ধারণা করা হয়।
মোটরসাইকেল হেলমেটের বিবর্তন
প্রথমদিকের হেলমেটের প্রাথমিক উপাদান ছিল কর্ক, চামড়া এবং ফোম। এই হেলমেট গুলো ছিল হালকা এবং শুধুমাত্র মাথার ওপরের অংশ ঢাকতে সক্ষম। হাফ-ফেস ডিজাইন মূলত মাথার খুলি রক্ষায় কার্যকর হলেও মুখ এবং চোয়াল সুরক্ষিত থাকত না। ১৯৬৮ সালে বেল হেলমেট কোম্পানি সর্বপ্রথম ফুল ফেস হেলমেট নিয়ে আসে যার নাম ছিল বেল স্টার।
এটি প্রধানত রেসারদের উদ্দেশ্যে বানানো হলেও ৭০ এর দশক থেকে মোটরসাইকেল প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও উচ্চ গতির অধিকারী হতে থাকে ফলে ব্যাবহারকারীদের মধ্যে এই ধরণের হেলমেট বেশ জনপ্রিয় হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সংস্থা হেলমেটের নিরাপত্তার মানদন্ড বা সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করা শুরু করে যার বিবরণ একটু পরে দেওয়া হবে।
১৯৮০ এর দশক থেকে শক্তিশালী মেটেরিয়াল যেমন ফাইবারগ্লাস এবং কেভলার ব্যবহার শুরু হয়, হেলমেটে ভাইসর যুক্ত করা হয়, যা চোখকে ধুলা, বৃষ্টি এবং পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে। এর সাথে উন্নত ভেন্টিলেশন সিস্টেম যোগ করা হয়, যা লং রাইড আরামদায়ক করে তোলে।
৯০ দশক থেকে আরাম এবং ফাংশনালিটির জন্য হাফ-ফেস এবং ফুল-ফেস হেলমেটের সুবিধাগুলোকে একত্রিত করতে ফ্লিপ-আপ বা মডিউলার হেলমেট তৈরি হয়। এই ধরনের হেলমেটের সামনের অংশ খোলা বা বন্ধ করার ফিচারটি রাইডারদের জন্য আরও সুবিধাজনক করে তোলে। ২০০০ এর পর থেকে আমরা উন্নতমানের বর্তমান হেলমেট গুলো দেখতে পাই যা ক্রমাগত প্রযুক্তিগত এবং নিরাপত্তার দিক থেকে উন্নত হচ্ছে।
মোটরসাইকেল হেলমেটের সার্টিফিকেশন
যেমনটা আগে বলা হয়েছে, সার্টিফিকেশন হচ্ছে হেলমেটের নিরাপত্তার মানদন্ড যা বিভিন্ন সংস্থা কতৃক দেওয়া হয়। ইম্প্যাক্ট, পেনিট্রেশন, চিন স্ট্র্যাপ, থার্মাল, ভাইজর ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একটি হেলমেটে সার্টিফিকেশন গুলো দেওয়া হয়। আমরা DOT, ECE, ISI, SNELL, SHARP এই ধরনের সার্টিফিকেশনের সাথে পরিচিত। জেনে নেওয়া যাক কোন সার্টিফিকেশন কি অর্থ বহন করে।
DOT (Department of Transportation): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মান যা FMVSS 218 অনুযায়ী হেলমেটে বিভিন্ন পরীক্ষা চালায় এবং সার্টিফিকেশন প্রদান করে।
ECE (Economic Commission for Europe): ইউরোপীয় ইউনিয়নের মান। ECE 22.05 অন্যতম নিরাপদ হেলমেট হিসেবে বিবেচিত। বর্তমান সংস্করণ ECE 22.06 সম্প্রতি আরো নিরাপদ বলে পরীক্ষিত হয়েছে।
Snell: কঠোর মানের জন্য পরিচিত। রেসিং এবং উচ্চগতির রাইডিংয়ের জন্য এই সার্টিফিকেশন প্রযোজ্য হয়।
SHARP (Safety Helmet Assessment and Rating Program): যুক্তরাজ্যের মান। একটি হেলমেটের ওভারঅল ৫ স্টার রেটিং সিস্টেম হিসেবে এই সার্টিফিকেশন টি বিবেচিত।
ISI (Indian Standards Institute): ভারতীয় মান। BIS (Bureau of Indian Standards) দ্বারা নির্ধারিত। ভারতে তৈরী হওয়া সকল হেলমেটে এই সার্টিফিকেশন ব্যাবহার বাধ্যতামূলক হলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই সার্টিফিকেশন তেমন একটা গ্রহণযোগ্য নয় এবং উপরের সার্টিফিকেশন গুলো সেফটি রেটিং হিসেবে বেশ ভালভাবে বিবেচিত।
সাধারণ বাইকারদের জন্য DOT অথবা ECE সার্টিফাইড হেলমেটগুলো সহজলভ্য এবং আন্তর্জাতিকভাবে রেকোমেন্ডেড।
মোটরসাইকেল হেলমেটের সঠিক মাপ নির্ধারণ
সার্টিফাইড হেলমেট কিনলেই শুধু হবে না, সঠিক মাপের হেলমেট না কেনার কারনে দূর্ঘটনায় নিরাপত্তার বদলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। আমরা অনেকেই জানি না কিভাবে হেলমেটের সঠিক মাপ নির্ধারণ করা হয়। হেলমেটের সঠিক মাপ নির্ধারণের উপায় নিচে বর্ণনা করা হলো।
একটি মেজারিং টেপ কপালের সামনের অংশে রাখতে হবে (ভ্রুর ঠিক উপরে)। মাথার সবচেয়ে চওড়া অংশ দিয়ে (কানের উপরে) টেপটি পিছনে নিয়ে মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ পরিধি মেপে মাপটি সেন্টিমিটারে নোট করতে হবে। যেমন- মাথার গড় পরিধি হতে পারে ৫৬-৫৮ সেমি।
প্রতিটি হেলমেট ব্র্যান্ডের নিজস্ব সাইজ চার্ট থাকে। আপনার মাপ অনুসারে সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডের চার্ট থেকে সঠিক সাইজ বেছে নিন।
সাধারণত হেলমেটের সাইজগুলো হয়:
XS (Extra Small): ৫৩-৫৪ সেমি
S (Small): ৫৫-৫৬ সেমি
M (Medium): ৫৭-৫৮ সেমি
L (Large): ৫৯-৬০ সেমি
XL (Extra Large): ৬১-৬২ সেমি
(কোম্পানি ও প্রস্তুতকারক দেশ অনুযায়ী সাইজ চার্টের তারতম্য হতে পারে)
সাইজ নির্ধারণের পর দোকান থেকেই হেলমেট টি ট্রায়াল দিয়ে দেখা উচিৎ হেলমেটটি snug ফিট কি না, অর্থাৎ খুব বেশি টাইট বা খুব বেশি ঢিলা হওয়া উচিত নয়। মাথা নাড়িয়ে দেখুন পর্যবেক্ষণ করতে হবে হেলমেটটি যেন সরে না যায়। চোয়ালের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা থাকতে হবে ও ভাইসরটি চোখ ও নাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভিউয়িং এঙ্গেল দিচ্ছে কিনা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে GearX, MT, Yohe, LS2, Bilmola, Vega, Axor, Axxis, NZI, Fibra, Studds, SMK, Shark, Scorpion, Suomy ইত্যাদি ব্র্যান্ডের সার্টিফাইড হেলমেট এভেইলেবেল যা মাত্র ৩০০০ টাকা থেকে শুরু করে লক্ষ টাকার উপরেও পাওয়া যায়, আপনার সামর্থ্যের অনুযায়ী আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্পন্য করা উচিৎ নয়।
রাইডারভেদে উপযোগী হেলমেট
যারা শহরের ভেতর স্বল্প গতিতে বাইক ও স্কুটার রাইড করেন তাদের জন্য হাফ ফেস হেলমেট স্বাচ্ছন্দ্যের হতে পারে, লং রাইড এবং দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাবহারকারীদের জন্য ফুল ফেস হেলমেট গুরুত্বপূর্ণ। তবে এক্ষেত্রে মডিউলার হেলমেট দুই ধরনের রোড কন্ডিশনেই স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তা দিবে।
উচ্চগতির রাইডিংয়ে এরোডাইনামিক ডিজাইন এবং লাইট ওয়েট ফিট থাকা আবশ্যক, তাই রেসিং হেলমেট ব্যাবহার করা উচিৎ যা শক্তিশালী উপকরণ যেমন কেভলার এবং কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। অফ-রোডে প্রায়ই ধুলা, মাটি এবং পাথরের ঝুঁকি থাকে তাই এক্ষেত্রে ডার্ট হেলমেট খুবই ভাল সাপোর্ট দিবে।
প্রিয় বাইকার, সবসময় সার্টিফাইড হেলমেট ব্যাবহার করুন এবং নিরাপদে রাইড করুন।
