Lifan KPR 165 ৩০,০০০ কিলোমিটার মালিকানা রিভিউ - মানিক

This page was last updated on 30-Jul-2024 08:54am , By Shuvo Bangla

আমি নুরুল আফসার মানিক । আমি একটি Lifan KPR 165 বাইক ব্যবহার করি । বাইকটি বর্তমানে ৩০,০০০+ কিলোমিটার চলছে । এটি আমার প্রথম বাইক আমি বর্তমানে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় বসবাস করি। আমার জীবনের প্রথম বাইক ছিল Hero Honda CBZ Extreme। যেটি আমি প্রায় ৫০,০০০ কিলোমিটার চালিয়েছিলাম।

কেন বাইক এবং বাইকিং ভালবাসি - 

কেন বাইক ভালবাসি তা বলতে গেলে আসলে শেষ হবে না। শুধু এতটুকু বলবো এই দুই চাকার বাহনে অনেক আবেগ লুকিয়ে আছে। এই ২ চাকার বাইক এতই ভাল লেগে গেছে যে বর্তমানে বাস, কার ও অন্যান্য কোন যানবাহন আর ভাল লাগে না।

আর বাইকিং কেন ভাল লাগে তা বলতে গেলে বলবো বাইকিং কমিউনিটিতে অনেক কিছু শেখার আছে। যখন বাইক কিনলাম ২০১৬ সালে তখন বাইকিং কমিউনিটি তেমন ছিল না। পরে জানতে পারলাম BikeBD সহ আরো কিছু সংখ্যক বাইকিং কমিউনিটি আছে যারা বিভিন্ন ভাবে বাইকারদের বাইকিং এবং সেইফটি নিয়ে তথ্য দিয়ে থাকেন।


তখন থেকেই আমি BikeBD এর একজন মেম্বার হই। আর বাইকিং কমিউনিটি ভাল লাগার কারণ হচ্ছে এই Helping Hand এর কারণে। কোন সমস্যায় পরে গেলে একটা পোস্ট করতেই নিমিষেই কমেন্ট বক্সের মাধ্যমে সমাধান পেয়ে যাই, এর থেকে ভাল আর কি হতে পারে।

কিভাবে বাইকটি বেছে নিলাম -

আমার জীবনে প্রথম বাইক ছিল Hero Honda CBZ Extreme যেটি আমি প্রায় ৫০ হাজার কিলোমিটার চালিয়েছি। তারপর সেটি বিক্রয় করে Yamaha Fazer Fi v2 নিলাম যেটি চালিয়েছি ৩২ হাজার কিলোমিটার । কিন্তু আমি ওই বাইক গুলোতে যথেষ্ট পাওয়ার পেতাম না যা আমার ট্যুরে ভাল সাপোর্ট দিবে।

আমি সাধারণত একটানা ননস্টপ চালাতে পছন্দ করি তাই দীর্ঘক্ষণ একটানা বাইক চালালে আমি ইঞ্জিনে পাওয়ার লছ অনুভব করতাম। যার কারনে আমি চিন্তা করেছি আমি একটি লিকুইড কুলড সিস্টেম বাইক কিনবো। আমার বাজেট তেমন বেশি ছিল না বিধায় আমি চিন্তায় পরে গেছি বাজেটে কোন বাইক এফোর্ড করতে পারবো।

এর মধ্যে আমি Club KPR গ্রুপের কিছু বড় ভাইদের সাথে আলাপ করলাম লিফান বাইক নিয়ে। সবাই আমাকে খুবি আশ্বাস দিয়েছে। আমিও ভয় পাচ্ছিলাম বাইকটি কিনতে। কারন সবাই বলছে ব্রান্ড এর বাইক বাদ দিয়ে এখন চায়না বাইক নিচ্ছ পরে পস্তাবে। চায়না বেশি দিন যায়না আরো কত কি।


এগুলা শুনার পর মন টা খুবই খারাপ হয়ে যায়। তারপর নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে অবশেষে ২০২০ সালে আমি লিফান কেপিয়ার বাইকটি কিনে ফেলি। আর কেনার পর এলাকায় সবাই বলতে লাগলো হায়রে ভাই "দুধ বিক্রি করে মদ কিনলেন"। এই ছিল আমার আমার বাইক কেনার ইতিহাস।

কি কারণে বাইক ব্যবহার করছি -

আসলে আমি বাইক কিনেছি শুধু মাত্র ভ্রমণ করার উদ্দেশ্যে, কারণ আমার বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব খুবই কম তাই আমি শুধু ট্যুর কে ফোকাস করেই বাইকটি কিনেছি। আর আমি ভ্রমণ করছি সারা দেশের আনাচে কানাচে ।


বাইকটির মূল্য ও যেখান থেকে কিনেছি - 

বাইকটি আমি ফুল লকডাউন মানে করোনার সময়ে কিনেছিলাম। আর তখন বাইকের অফার চলছিলো। এটির বাজার মূল্য ছিলো ২,১৫,০০০/- ( দুই লক্ষ পনের হাজার টাকা) আর আমি অফারে কিনেছি ১,৯৫,০০০/- (এক লক্ষ পঁচানব্বই হাজার টাকা) দিয়ে। অফার ছিল তাই সুযোগ টা হাত ছাড়া করিনি।

বাইকটি কিনেছি লিফান এর শোরুম JME MOTORS থেকে। যার ওনার হচ্ছে আমাদের শ্রদ্ধেয় বখতিয়ার ভাই। খুবি হেল্পফুল একজন মানুষ। যিনি আমাকে কঠিন করোনার মধ্যে ও ৭ দিনের মধ্যে রেজিষ্ট্রেশন করিয়ে দিয়েছিলেন।


বাইকের ফিচার গুলো -

  • ১৬৫ সিসি ইঞ্জিন
  • লিকুইড কুলড
  • ১৭ নিউটন মিটার টর্ক
  • হর্স পাওয়ার ১৬.৮
  • EFI সিস্টেম
  • প্রজেকশন হেড লাইট
  • ৬ টি গিয়ার

প্রথমবার চালানোর অভিজ্ঞতা - 

বাইকটি পথমবার যখন চালাই তখন আমার Yamaha fazer বাইক ছিল। লিফান কেপিয়ার চালানোর পর এর ইঞ্জিনের পাওয়ার আর টর্ক দেখে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এটা একটা চায়না বাইক। এত ছোট একটা বাইকে এত পাওয়ার কোথা থেকে আসে আমি ভেবেই পাইনি। তবে বাইকটির ওজন কম হলে স্পিড আর টর্ক আরো বেশি আসতো।

মূলত প্রথম রাইডের পরই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে অভার টেকিং এ কনফিডেন্স বাড়াতে হলে এই বাইকটিই যথেষ্ট। আর এই জন্যই আমি এই বাইকের বর্তমান ওনার।

যতবার সার্ভিসিং করিয়েছি -

বাইকটি কেনার পর ১০০০ কিলোমিটার এর ভিতর সার্ভিসিং করেছিলাম। সাধারনত আমার ফ্রি সার্ভিস গুলা ভাল লাগে না তাই আমি এর পর প্রতি ৪০০০ কিলোমিটার পর পর সার্ভিসিং করাতাম। সার্ভিসং গুলো আমি চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটের পাসে ABS Ontim ভাই এর স্লিপার ক্লাচে (Slipper Clutch) এ করাতাম।

উনি সাধারনত প্রিমিয়াম সেগমেন্ট এর বাইকের কাজ ভাল করে তাই উনাকে দিয়ে করাতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আর উনার ব্যাবহার একদমি ফ্রেন্ডলি বন্ধুর মত।

২৫০০ কিলোমিটার আগে ও পরে মাইলেজ - 

বেইক ইন পিরিয়ডে মাইলেজ পেয়েছিলাম ৩০-৩৫ কিলোমিটার। ৪০০০ কিলোমিটার পর থেকে পেয়েছিলাম ৪০ - ৪৫ এভারেজ। যা পেয়ে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট।

বাইকের যত্ন যেভাবে নেই -

প্রথমত আমি বাইক সব সময় নতুনের মত রাখি। প্রত্যেকবার ধোয়ার পরে WD40 দিয়ে জং ধরার মত স্থানে স্প্রে করি। চেইন আর টায়ার প্রেসার চেক করি। বিশেষ করে ওয়েরিং গুলা আমি ভাল ভাবে ওয়াটারপ্রুফ করেছি যাতে বর্ষাকালে বিপদে না পরি। আর চেইন এডজাস্টমেন্ট ঠিক রাখি যাতে মাইলেজ ভাল পাই।

আর আমি সবসময় ভাঙ্গা রাস্তা ঘাট আর গতিরোধক মেনে চলি যার কারনে আমার ৩০ হাজার চলা বাইকে এখনো স্টেয়ারিং বল রেসার পরিবির্তন করা লাগেনি। ওয়েল সিল ও কাটে নি এখনো পর্যন্ত।

যেভাবে বাইকের যত্ন করি - 

সাধারণত টুকটাক বাইকের কাজ আমি নিজেই করি যেমন, ক্লাচ এডজাস্টমেন্ট, ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন, কুলেন্ট পরিবর্তন, চেইন এডজাস্টমেন্ট, ওয়েরিং চেক আপ , ব্যাটারি পরিবর্তন ইত্যাদি। এছাড়া আমি আমার বাইক নিজে ওয়াশ করি।

বাইকে যা যা পরিবর্তন করেছি এবং কেন - 

বাইকে ৩০ হাজার কিলোমিটার এ এখন পর্যন্ত পরিবর্তন করেছি,- টায়ার, স্পার্ক প্লাগ, ব্রেক প্যাড, ক্লাচ ক্যাবল, ইন্ডিকেটর লাইট, চেইন সেট, লুকিং গ্লাস। প্রত্যেকটা পার্টস পরিবর্তন করেছি । আর লুকিং গ্লাস লাগিয়েছি R15 v2 এর টা।

বাইকের মডিফাই - 

আমি মডিফাই করা তেমন পছন্দ করি না স্টকই আমার কাছে ভাল লাগে। শুধু একটি শাড়ি গার্ড লাগিয়েছি Pulsar এর। এছাড়া মোবাইল হোল্ডার, মোবাইল চার্জার, ফগ লাইট ইত্যাদি লাগিয়েছিলাম ট্যুর এর জন্য।
 

বাইক নিয়ে তোলা সর্বোচ্চ স্পিড - 

সাধারণত আমি স্পিডিং পছন্দ করি না তবে স্কিল থাকা উচিৎ। আমি ঢাকা চিটাগং হাইওয়ে তে টপ স্পীড তুলেছিলাম নরমালি ১৩৫ এর মত। আমার ওয়েট ৯৮ কেজি যার কারণে হয়তো একটু কম পেয়েছি।
 

Lifan KPR 165 বাইকটির কিছু ভাল দিক -

  • লুকিং খুবই ভাল
  • ওয়েট ব্যালেন্স ভাল
  • ব্রেকিং কন্ট্রোলিং ভাল
  • টর্ক আর টপ স্পিড ২টাই ভাল
  • একটু নিচু হওয়াতে আমার মা আর আমার স্ত্রী খুব সহজে বাইকে উঠে যেতে পারে

Lifan KPR 165 বাইকের কিছু খারাপ দিক -

  • ওয়েরিং সিস্টেম একটি দূর্বল
  • হেড লাইটের আলো তুলনামূলক কম
  • মিটার টা বেশি ছোট লাগে আমার কাছে
  • সাস্পেনশন পিছনের টা খুব হার্ড
  • একটানা চালালে শহরে জ্যামের মধ্যে বসে থাকলে রেডিয়েটর এর গরম পায়ে লাগে।


বাইকটি নিয়ে লং ট্যুর - 

বাইকটি নিয়ে লম্বা ট্যুর বলতে গেলে একবার কাপ্তাই থেকে বান্দরবান ,নীলাচল , থানচি , আলীকদম, কক্সবাজার গিয়েছি। সেই এক দিনে রাতে আবার কক্সবাজার হতে চট্টগ্রাম , পটিয়া , কালুরঘাট ব্রিজ , কাপ্তাই রাস্তারমাথা হয়ে কাপ্তাই এসে গেছি। এটাই ছিলো লিফান দিয়ে আমার ডে লং ট্যুর। হয়তো প্রায় ৬০০ কিলোমিটার এর মত রাইড করেছি ২৪ ঘন্টার মধ্যে। বাইকের পারফর্মেন্স আমাকে খুবই অবাক করেছে কারন আমার সাথে পিলিওন ছিল। পাওয়ার ড্রপ করেনি একবারো।
 

চুড়ান্ত মতামত -

বাইকটি নিয়ে বললে বলা শেষ হবে না, তবে এইটুকু বলবো এই বাজেটে পয়সা উশুল বলা চলে। আর যারা আমাকে বলেছিল চায়না বেশি দিন যায়না তারা এখন আমাকে বলে ভাই কত কিলো চলেছে আর ইঞ্জিনে কয়বার হাত দিছেন। এর পর তারাই বলে ভাই চায়না হলেও এটা অরিজিনাল চায়না যার কারণে লাস্টিং বেশি করে এগুলো।
 
যাইহোক আমি আমার লাইফে অনেক বাইকের মধ্যে এই বাইক সব চেয়ে বেশি ব্যবহার করেছি। অনেকেই বলে স্পোর্টস বাইক রাফ ব্যবহার বা ডেইলি কাজের জন্য ব্যবহার করা যায় না কিন্তু আসলে একদমি এমনটা নয়। আমি এই বাইককে খুবি অত্যাচার করি যা বলার মত না। যারা হিল এরিয়াতে থাকে তারা জানে বাইকের টর্চার কাকে বলে।
 
তবে বাইকের কিছু জিনিস পরিবর্তন করা উচিৎ। যেমন চেইন সেট, এবিএস সিস্টেম, লাইট ওয়েট, Led Indicator, হাইট একটু বেশি হলে ভাল এগুলাই পরিবর্তন করে বাজারে নতুন করে আনলে ভাল হবে বলে আমি মনে করি। আর যারা লিফান ব্রান্ড এর বাইক নিতে চান চোখ বন্ধ করে নিতে পারেন কারন কোন সমস্যায় পড়ে গেলে #CKB গ্রুপ আপনাকে যথেষ্ট হেল্প করবে। কষ্ট করে রিভিউ টা পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
 

লিখেছেনঃ নুরুল আফসার মানিক

আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com – এই ইমেইল এড্রেসে।