লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু - টীম বাইকবিডি রিভিউ
This page was last updated on 18-Aug-2024 01:01pm , By Shuvo Bangla
Lifan KP 150 এবং KPR 150 বাইকদুটিকে ৫০ হাজার কিলোমিটার টেস্ট করার পেছনে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশের রাস্তায় বাইকদুটির পারফর্মেন্স যাচাই করা। কাগজে কলমে লিফান কেপি১৫০ ভি-টু বাইকটি হচ্ছে কেপি ১৫০ এবং কেপিআর ১৫০ এর সংমিশ্রন, ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়, যে এই সংমিশ্রনটি কি বাস্তব প্রেক্ষাপটে বাকি বাইকদুটির মতোই অসাধারন পারফর্ম করবে ? চলুন জেনে নেয়া যাক আমাদের লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু টেস্ট রাইড রিভিউ এর মাধ্যমে।
লিফান কেপি ১৫০ ভি টু - টীম বাইকবিডি রিভিউ
Lifan KP 150 Review
বাইরে থেকে বাইকটি দেখতে সম্পূর্ন লিফান কেপি ১৫০ এর মতোই – কিন্তু ভালোভাবে দেখলেই কিছু পার্থক্য ধরা পড়বে। লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু বাইকটিতে দেয়া হয়েছে একটি শক্তিশালি লিকুইড কুলড ইঞ্জিন , যা ১৪.৮ ব্রেক হর্সপাওয়ার এবং ১৪ এনএম টর্ক উতপন্ন করে। এই শক্তিশালি ইঞ্জিনের শক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে একটি ৬-স্পীড গিয়ারবক্সের মাধ্যমে, তবে অন্যান্য বাইকের তূলনায় এই বাইকটি গিয়ার রেশিও কিছুটা লম্বা। লিফান কেপি১৫০ ভি-টু বাইকটির ইঞ্জিন সম্পূর্ন লিফান কেপিআর ১৫০ বাইকটির ইঞ্জিনের মতোই, তবে সুবিধা হলো, বাইকটি নেকেড বাইক হওয়ায় কোনপ্রকারের বডিকিট নেই, ফলে শহরের রাস্তায় বডিকিট নিয়ে রাইডারের কোনপ্রকার দুশ্চিন্তা করতে হবে না। লিফান কেপিআর ১৫০ বাইকটির অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে এর ইঞ্জিনের অতি দ্রুত গরম হয়ে যাওয়া। কিন্তু , যেহেতু লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু বাইকটি একই ইঞ্জিনবিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এর ইঞ্জিনের সামনে কোনপ্রকারের কিট দিয়ে আবৃত করা নেই, কাজেই এর ইঞ্জিন অতিদ্রুত গরম হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বাইকটি টেস্ট করার সময় আমরা লক্ষ্য করেছি যে বাইকটির ইঞ্জিনে প্রচুর পরিমানে বাতাস প্রবাহিত হয় এবং একই সাথে এর লিকুইড কুল টেকনোলজি কাজ করতে থাকার ফলে এর ইঞ্জিন খুব সহজে গরম হয় না।
লিফান কেপি ভি-টু একই সাথে ভদ্র এবং আক্রমনাত্মক চেহারাসমৃদ্ধ একটি নেকেড স্পোর্টস বাইক। কেপি১৫০ বাইকটির সাথে প্রথম দেখায় এর বাহ্যিক যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হলো লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু এর আধুনিক ডিজাইনের ট্যাংকের দুপাশের কাউলিং কিছুটা বড়, যা রেডিয়েটর এর সাথে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। রেডিয়েটরের সামনে একটি শক্ত প্লাস্টিকের গ্রিল লাগানো রয়েছে যা রেডিয়েটরকে সকল প্রকার ধুলো-ময়লা ও রাস্তায় পড়ে থাকা ধাতুর টুকরো বা যেকোন প্রকারের শক্ত কিছুর টুকরো থেকে রক্ষা করে। লিফান কেপি১৫০ ভি-টু বাইকটির হেডলাইটের নিচের দিকে দুটো নীল রঙের পার্কিং লাইট রয়েছে যা বাইকটিকে একটু অন্যরকম, অনেকটা এলিয়েন এর মতো দেখায়। বাইকের হেডলাইটটি ডিসি, এবং যথেষ্ট শক্তিশালী। পেছনের টেইললাইটটি দেখতে লিফান কেপি১৫০ এর মতো, তবে বাল্বটি এলইডি হওয়ায় রাতে অনেকদুর থেকেও পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। ইন্ডিকেটরগুলো স্বচ্ছ এবং আকর্ষনীয়, একই সাথে সেগুলো অন্যান্য বাইকের তূলনায় কিছুটা অন্যভাবে বানানো হয়েছে, ফলে যেকোন ধাক্কায় ইন্ডিকেটরগুলো ভেঙে না গিয়ে বেকে যাবে যা পরবর্তীতে সোজা করে ফেলা যাবে।
বাইকটির স্পীডোমিটারে স্পীডোমিটার ডিসপ্লে, আরপিএম মিটার, ট্রিপ মিটার, ফুয়েল মিটার, ঘড়ি , ইঞ্জিনের কুলিং লিকুইড ওয়ার্নিং লাইট এবং গিয়ার এর নাম্বার ইন্ডিকেটর রয়েছে। ফলে, রাইডার একটি স্পীডোমিটারেই প্রচুর প্রয়োজনীয় ফিচার পাচ্ছেন। বাইকটির স্পিডোমিটার দেশের বাজারে থাকা অন্যান্য বাইকের চাইতে আলাদা , কারন বাইকটির স্পীডোমিটারের ডিসপ্লে রাইডারের ইচ্ছেমতোন কিলোমিটার বা মাইল – যেকোন ফরম্যাটে নেয়া যায়। উভয় হ্যান্ডেলবারে থাকা সুইচ এবং কন্ট্রোলগুলো খুবই ভালোমানের। বাইকটির সিটিং পজিশন কিছুটা সোজাসুজি এবং সিটটি সামান্য উচু। রাইডারের সিট যথেষ্ট পরিমানে আরামদায়ক , তবে পেছনের সিটটি আরেকটু বেশি আরামদায়ক হলে ভালো হতো।
কেপি১৫০ ভি-টু বাইকটি যথেষ্ট পরিমানে পেশিবহুল, বাইকটির হ্যান্ডলিং এবং ব্রেকিং সেগমেন্টের অন্যান্য বাইকের তূলনায় অসাধারন। তবে, টেস্ট রাইডিং এর সময় আমরা একটি প্রশস্ত পেছনের টায়ারের অভাব বোধ করেছি, কারন ১১০ সাইজের রিয়ার টায়ার বাইকটির অসাধারন টর্ক বহন করার জন্য যথেষ্ট নয়। বাইকটির উভয় চাকাতেই টিউবলেস টায়ার রয়েছে এবং উভয় ব্রেকই ডিস্ক ব্রেক। পরিশেষে আমরা বলতেই পারি, যে আমরা বাইকটির পারফর্মেন্স নিয়ে সন্তুষ্ট। যখন বাইকটিকে নিয়ে কর্নারিং করা হয়, তখন এর অসাধারন ব্রেকিং, কন্ট্রোলিং এবং সাসপেনশন – সবকিছু মিলে এক নিখুত শিল্পের সৃষ্টি করে।
বাইকটির সামনের সাসপেনশন যথেষ্ট ভালো – তবে বাইকটির ব্যবহারকারীদের থেকে আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছি যে বাইকটির পেছনের সাসপেনশনটি সামনের সাসপেনশনের মতো যথেষ্ট ভালো নয় – এবং অভিযোগটি সত্য, বাইকটির পেছনের সাসপেনশন অন্যান্য বাইকগুলোর তূলনায় অতটা অসাধারন নয়। বাইকটির হর্নটি হচ্ছে একটি সিঙ্গেল ইউনিট হর্ন , যার পারফর্মেন্স সন্তোষজনক নয়।
বাইকটিতে শুধুমাত্র ইলেকট্রিক স্টার্টার রয়েছে, কোন কিক স্টার্টার দেয়া হয়নি , যা শীতকালে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বিশেষত যদি আপনি উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দা হন। উম্মুক্ত রাস্তায় বাইকটি চালিয়ে আমরা লক্ষ্য করেছি যে বাইকটির ব্যালেন্সিং খুবই ভালো, এবং বাইকটি দিয়ে খুবই ভালো কর্নারিং করা সম্ভব, তবে বাইকটির পেছনের টায়ার যথেষ্ট পরিমানে প্রশস্ত না হওয়ায় কর্নারিং এর সময় ব্রেকিং করতে গিয়ে সম্পূর্ন আত্মবিশ্বাসী হওয়া সম্ভব হয় না। ০ থেকে ১০০ কিমি/ঘন্টা গতি তোলার ক্ষেত্রে লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু বাইকটি সেগমেন্টের অন্যতম দ্রুততম বাইক। তবে, এর গিয়ার শিফটিং কিছুটা শক্ত হবার কারনে রাইডার সামান্য সময় নিয়ে গিয়ার শিফট করেন। রাসেল ইন্ড্রাস্ট্রিজ এর সার্ভিস টীম বলেছেন যে ২০০০ থেকে ২৫০০ কিলোমিটার পার হবার পরে বাইকটির গিয়ার শিফটিং আরো অনেক বেশি স্মুথ হয়ে যাবে।
পারফর্মেন্স এর সারসংক্ষেপ:
আমাদের টেস্ট রাইডিং পিরিয়ডে আমরা বাইকটি দিয়ে সর্বোচ্চ ১২৮ কিমি/ঘন্টা গতিবেগ তুলতে সক্ষম হয়েছি। শহরে আমরা মাইলেজ পেয়েছি ৩৮কিমি/লিটার, এবং হাইওয়েতে আমরা সর্বোচ্চ ৪৫ কিমি/লিটার পর্যন্ত মাইলেজ পেয়েছি। হাইওয়েতে বাইকটি পারফর্মেন্স অসাধারন, এবং লম্বা রাইডিংয়ে বাইকটি কোনপ্রকার ব্যাকপেইন বা স্ট্রেস দেয়নি। লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু বাইকটি নিয়ে আমরা অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছি যাতে করে আমরা বাইকটির সম্পর্কে সকলকিছু জানতে পারি। চলুন একনজরে দেখে নেয়া যাক বাইকটির টেস্ট রাইডের ফলাফলগুলো –
লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু পজিটিভ দিকগুলোঃ
- অত্যান্ত স্টাইলিশ চেহারা, ভালোমানের গ্রাফিক্স ও ডিজাইন।
- ফিচারসমৃদ্ধ ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল, টিউবলেস টায়ার, ভারী আওয়াজ এর এক্সহস্ট, পেছনে মনো সাসপেনশন, ডুয়েল ডিস্ক ব্রেক, ইত্যাদিসহ অসংখ্য আকর্ষনীয় ফিচার।
- অত্যান্ত ভালো এক্সেলেরেশন ও টপ স্পিড, সেগমেন্টের অন্য সকল বাইকের সাথে টেক্কা দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
- অত্যান্ত পরিশোধিত ও স্মুথ ইঞ্জিন, উচ্চগতিতেও ইঞ্জিন থেকে কোনপ্রকার ভাইব্রেশন অনুভব করা যায় না।
- এক্সেলেরেশন এবং টপ স্পীডের কথা বিবেচনা করলে বাইকটি বেশ ভালোমানের মাইলেজ দেয়।
- তূলনামুলক কম ওজনসম্পন্ন হওয়ায় এবং ১৫ + ৪৫ দাতের চেইন স্প্রকেট ব্যবহার করায় এটি উচ্চগতিতে অসাধারন পারফর্ম করে।
লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু নেগেটিভ দিকগুলোঃ
- বাইকটি পেছনের সাসপেনশনটি সন্তোষজনক নয়।
- বাইকটির গিয়ার শিফটিং স্মুথ নয়, কিছুটা শক্ত।
- বাইকটির হর্ন কোনভাবেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের জন্য যথেষ্ট নয়, বাইকটিতে ডাবল ইউনিটের হর্ন দেয়া প্রয়োজন ছিলো।
- ভিন্নরকম ডিজাইনের কারনে এয়ার ফিল্টার খুবই দ্রুত ময়লা হয়ে যায়।
- হ্যান্ডেল বার এর ঘুর্নন রেডিয়াস খুবই কম, ঢাকার ট্রাফিক জ্যামের জন্য যথেষ্ট নয়।
- কোন কিক স্টার্ট অপশন নেই, শুধুমাত্র ইলেকট্রিক ইগনিশন রয়েছে।
- স্পেয়ার পার্টসগুলো শুধুমাত্র তাদের শোরুমে পাওয়া যাবে। তবে কিছু কমন পার্টস যেমন ব্রেক শু, ব্রেক প্যাড, চেইন স্প্রোকেট, ইত্যাদি জনপ্রিয় ভারতীয় বাইকগুলো যেমন হোন্ডা ইউনিকর্ন, হিরো সিবিজেড , ইত্যাদির সাথে মিলে যায়।
- তারা বাংলাদেশের বাইকের বাজারে নতুন তাই তারা সেরা কাস্টোমার সেবা প্রদান করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
- বাইকটির পেছনে ১১০ সাইজের টায়ার যথেষ্ট নয়। এই স্থানে কমপক্ষে ১২০ সাইজের টায়ার দেয়া প্রয়োজন ছিলো।
- বাইকটির রঙের মান অতটা অসাধারন নয়।
- বাইকটির কালার অপশনগুলো অতটা আকর্ষনীয় নয়।
- স্পেয়ার পার্টস সারা বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে না – তবে রাসেল ইন্ডাস্ট্রিজ বলেছেন যে গ্রাহকের সুবিধার্থে তারা বাংলাদেশের যেকোন স্থানে তাদের বাইকের পার্টস কুরিয়ার করে পাঠাবে।
আমরা সর্বদাই বলেছি যে দাম অনুযায়ী লিফান কেপি ১৫০ বাইকটি অসাধারন একটি বাইক – লিফান কেপি ১৫০ ভি২ সেই বক্তব্যকে আরেকধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বাড়তি ২০ হাজার টাকা খরচের বিনিময়ে আপনি পাচ্ছেন একটি শক্তিশালি লিকুইড কুলড ইঞ্জিন, ২ বছরের ইঞ্জিন ওয়ারেন্টি, এবং ৫ বছরের ফ্রি আফটার সেলস সার্ভিস – আপনার বাজেট যদি ১.৬-১.৭ লাখ টাকা হয়, তবে লিফান কেপি ১৫০ ভি-টু বাইকটি আপনার জন্য অন্যতম সেরা পছন্দ হতে পারে।