বাংলাদেশে টিভিএস মোটরসাইকেলের নতুন ডিস্ট্রিবিউটর প্রাণ আর এফ এল
This page was last updated on 21-Oct-2025 09:19pm , By Arif Raihan Opu
বাংলাদেশের বাজারে জনপ্রিয় টিভিএস মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড তাদের নতুন ডিস্ট্রিবিউটর খুঁজে নিয়েছে। এখন থেকে বাংলাদেশে টিভিএস মোটরসাইকেলের নতুন ডিস্ট্রিবিউটর প্রান আর এফ এল কোম্পানী। উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশের বাজারে টিভিএস মোটরসাইকেল গুলো টিভিএস বাংলাদেশ অটোমোবাইলস লিমিটেড নামে একটি ডিস্ট্রিবিউশন প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করতো।

বাংলাদেশে টিভিএস মোটরসাইকেলের নতুন ডিস্ট্রিবিউটর প্রাণ আর এফ এল
টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেডের সাথে মুল TVS Motor Company এর ডিস্ট্রিবিউশনের চুক্তির মেয়াদ গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষ হওয়ার পরে আর নতুন করে সেটি নবায়ন করা হয়নি। সেইসুত্রে বলা যায়, ১লা অক্টোবর, ২০২৫ থেকে নতুন ডিস্ট্রিবিউশনের চুক্তিটি শুরু হয়েছে প্রাণ আর এফ এল কোম্পানির সাথে।
মূলত: গত বছর ২০২৪ সাল থেকেই টিভিএস বাংলাদেশের বাজারে তাদের পরিচালনা কিছুটা সীমিত করে ফেলেছিলো। এরমধ্যে বাজারে গুঞ্জনও ছিলো বাংলাদেশে টিভিএস নতুন ডিস্ট্রিবিউটর খুঁজছে। যার মধ্যে আলোচনায় ছিল বসুন্ধরা গ্রুপ, ফকির গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, রানার অটোমোবাইলস, প্রান আর এফ এল প্রভৃতি কোম্পানির নাম। তবে শেষ পর্যন্ত প্রান আর এফ এল বাংলাদেশের জন্য নতুন টিভিএস ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে সুযোগ পেল।

আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশে সকল মোটরসাইকেলের দাম
সম্প্রতি প্রাণ আর এফ এল, টিভিএস বাংলাদেশ এর দেশব্যাপী বেশকিছু পুরাতন ডিলারদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলো। যার ফলেই মুলত: জানা গিয়েছে প্রাণ আর এফ এল ও টিভিএস এর সম্পৃক্ততা। এরই মধ্যে টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেডের বেশ কিছু প্রান্তিক কর্মী কয়েকমাস ধরে ছাটাই হয়েছে। সবশেষে এই অক্টোবর মাসে এক কর্মী-সভায় জানিয়ে দেয়া হয়েছে টিভিএস এখন থেকে প্রাণ আর এফ এল বাজারজাত করবে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাণ আর এফ এল এ নিয়ে তাদের অফিসিয়াল কোন বিবৃতি প্রকাশ করেনি ।

প্রাণ আর এফ এল কি টিভিএস মোটরসাইকেলের উৎপাদনে যাবে?
প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছে যে, বাংলাদেশে টিভিএস মোটরসাইকেলের উৎপাদন টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছেই থাকবে। শুধু বাজারজাতকরন এর কাজটুকূ প্রাণ আর এফ এল করবে। যদি এই পদক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তাহলে বাজারে টিভিএস মোটরসাইকেলের কোন ঘাটতি থাকবে না আশা করা যায়।
আর যদি প্রাণ আর এফ এল বাংলাদেশের বাজারের জন্য নিজস্ব উৎপাদনে যায়, তাহলে বাজারে কমপক্ষে ১৮ মাসের একটি পন্য ঘাটতি থাকবে। কেননা, মোটরসাইকেলের জন্য শুন্য অবস্থা থেকে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করতে সাধারনত এরকম সময়ই লাগে।
আর ২০১৭ সালে মোটরসাইকেল নীতিমালা প্রনয়ন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী কোন কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন হয়নি। তাই এধরনের মালিকানা পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলো মোকাবেলা করে সম্পূর্ণ উৎপাদনমুখি হতে প্রাণ আর এফ এল কোম্পানীর বেশ সময় লাগার কথা।
নতুন টিভিএস এর মোটরসাইকেল ও স্কুটার গুলো কি আসবে?
হ্যাঁ নতুন মডেল অবশ্যই আসবে, পাইপলাইনে TVS এর ১৮০ সিসি, ২০০ সিসির Apache RTR, ১২৫ সিসির FI Ntorq স্কুটার তো আছেই, সেই সাথে আরো কিছু মোটরসাইকেল মডেলও বাংলাদেশে আসবে। সেইসাথে তাদের ৩০০ সিসির নতুন Apache RTX300 ও বাজারে আসার সম্ভবনা রয়েছে।
এখন অনেকেই আশা করতে পারেন TVS এর ৩০০ সিসির স্পোর্টসবাইক Apache RR310 মডেলটি কি আসবে! আমাদের ধারনা আগামি ২ বছরের মধ্যে এটা বাংলাদেশের বাজারে আসার সম্ভবনা বেশ কম। কারন এটি BMW এর মেকানিজমে তৈরী। যার টেকনোলজি BMW এতো সহজে অন্য দেশে উৎপাদনের জন্য শেয়ার করবে না।
কি কারনে টিভিএস তাদের ডিস্ট্রিবিউটার চেঞ্জ করলো?
এবিষয়ে বাজারে বেশ কিছু তথ্য রয়েছে। কিন্তু আমরা যা ধারনা করছি, টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেডের অতিরিক্ত আমদানির কারনে ২০২৩ এর শেষদিকে অনেক সংখ্যক মোটরসাইকেল (৭৫,০০০ ইউনিটের কাছাকাছি) তাদের স্টকে জমে যায়। যা মূলত: ২০২৪ সালের প্রথম থেকে তারা বাজারে বিক্রি শুরু করে স্টক কমিয়ে তাদের ফান্ড রিয়ালাইজ করে।
এই দীর্ঘসময়ে তারা টিভিএস ইন্ডিয়ার কাছে নতুন করে আর কোনো বাইক বা নতুন কোন মডেলের জন্য ও এলসি ওপেন করেনি। স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো মাদার কোম্পানি তাদের পন্য ধারাবহিকভাবে বিক্রির একটা চাপ ডিস্ট্রিবিউটার উপর দিয়েই থাকে। কিন্তু স্টক-ক্লিয়ারেন্সে ব্যস্ত টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেড ধারাবহিকভাবে নতুন কোনো এলসি না খুলে সময়ক্ষেপণ করায় টিভিএস ইন্ডিয়া সেটি ভালোভাবে নেয়নি।
টিভিএস এর নিস্ক্রিয়তায় কাদের উপকার হয়েছে?
TVS Ntorq 125 বাংলাদেশে স্কুটার সেগমেন্টে বেশ জনপ্রিয় একটি স্কুটার। বাজারে এটার সরবরাহ কম থাকায় বেশি বিক্রি হয়েছে Suzuki Access 125। এরপর বাজারে TVS Stiker 125 এর লেটেস্ট ভারশন না আসায় Hero Xtreme 125 এই সেগমেন্টটি দখল করে নিয়েছে।
আবার ১৫০ সিসি এর জনপ্রিয় মডেল ছিলো TVS Apache RTR, যার মার্কেট ডিভাইড হয়েছে Suzuki Gixxer Monotone ও Yamaha FZ সিরিজে। আর TVS এর ১০০ থেকে ১১০ সিসির কমিউটার মোটরসাইকেল গুলোর কাস্টমার সবচেয়ে বেশি শিফট হয়েছে HERO তে। HERO এর গত ২ বছরের সেলস ফিগার চেক করলেই বিষয়টা আরো পরিস্কার হয়।
প্রাণ আর এফ এল কি কি চ্যলেঞ্জ ফেস করবে?
১। প্রান আর এফ এল মূলত: মোটরসাইকেল ব্যাবসায়ী না। ফলে তারা হয়তো তাদের গতবাঁধা অফিস ও এই সেক্টরে অনভিজ্ঞ ফিল্ড-ফোর্স নিয়েই বাংলাদেশের মোটরসাইকেল মার্কেটে প্রবেশ করতে চাইবে। ফলে বিশেষ করে আফটারসেলস সার্ভিস ও মার্কেটিং এ তারা যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ ফেস করবে।
২। এখানকার সময়ে বাংলাদেশে TVS এর অপারেশনে পক্ষ মূলত: তিনটা; টিভিএস ইন্ডিয়া, প্রাণ আর এফ এল, ও টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেড। ফলে এই তিন পক্ষের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ধীরগতি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে।
৩। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলি সবসমই তাদের পন্যটিকেই বাজারের সেরা মনে করে। ফলে তাদের প্রডাক্টগুলির যে সময়ের সাথে উন্নয়ন প্রয়োজন অথবা বাংলাদেশের পথঘাটের প্রেক্ষিতে সেসবের কিছু লোকালাইজেশন বা মডিফেকেশন প্রয়োজন হতে পারে সেটি মানতে নারাজ থাকে।
উদাহরন স্বরুপ বলা যায়, বাংলাদেশের কাস্টমাররা তাদের বাইকের পিছনে একটু মোটা চাকা পছন্দ করে এবং তাতে বাড়তি একটি কনফিডেন্সও উপভোগ করে। কিন্তু ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলির যুক্তি থাকে মোটা চাকা তাদের বাইকের মাইলেজ কমাবে। কথাটি সত্যি হলেও আমাদের কাস্টমারদের চাহিদা তারা পুরোপুরি এড়িয়ে যায়।
এক্ষেত্রে টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেড এর ডিস্ট্রিবিউশনের সময় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের বাজারে তারা টিভিএস এর বিভিন্ন মডেল এনে অনেকটা সময় ধরে রাস্তায় চালিয়ে দেখে এদেশের রাস্তার ও কাস্টমারদের উপযোগী করে তারপর বিক্রি শুরু করত। আর এই সুবিধাটুকু নতুন প্রাণ আর এফ এল কতটুকু করতে পারবে তার আশংকা থেকে যায়।
৪। এখনকার নতুন মডেলের বাইকগুলো প্রথমেই টিভিএস বাংলাদেশের বাজারে দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। কারন টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেড এখনো উৎপাদনে রয়েছে। আর প্রাণ আর এফ এল যাতে অতি দ্রুত নিজেদের মানুফ্যাক্চারিং প্ল্যান্ট স্থাপনে আগ্রহী হয়, অথবা টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেডের মানুফ্যাকচারিং প্রসেস নিজেদের হাতে নেয়ার প্রক্রিয়া সাধন করে সেজন্য নতুন মডেল লাইনআপ না দেবার সম্ভাবনাই বেশি।
৫। প্রাণ আর এফ এল স্ট্রাটেজিক্যালি সবসময় পুশ-সেল করে থাকে। আর আমাদের মোটরসাইকেল মার্কেটও মোটামুটি পুশ-সেলস নির্ভর। তবে আগের মতো TVS যদি বাইকার কমিনিউটি কেন্দ্রিক, বাইকারের লাইফস্টাইল কেন্দ্রিক, অনলাইন কমিউনিটি কেন্দ্রিক কার্যক্রম তেমনভাবে না করে সেক্ষেত্রে মার্কেট-হাইপ ক্রিয়েট হবে না। আর এই মার্কেট-হাইপ নতুনভাবে ক্রিয়েট করতেও তাদের মিনিমাম ১.৫ থেকে ৩ বছর সময় লাগবে।
প্রান আর এফ এল জন্য সুবিধাজনক দিকগুলো
১। প্রাণ আর এফ এল তাদের মোটরসাইকেল ডিস্ট্রিবিউশনে ও পরবর্তিতে উৎপাদনে যেতে বাড়তি কিছু সুবিধা পেতে পারে। তারা তাদের প্লাস্টিক প্লান্ট থেকে মোটরসাইকেলের জন্য ম্যাক্সিমাম প্লাস্টিক পার্টস এর সাপোর্ট নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে তারা দ্রুত ক্যাটাগরি-১ টাইপ ম্যানুফ্যাক্চারার হিসেবে স্বীকৃতি নিতে পারবে। এতে লো-ট্যাক্স বেনিফিট পাবে ও সেইসাথে প্রডাক্ট প্রাইসেও একটা ভালো প্রতিযোগীতা তৈরী করতে পারবে। (**কিন্তু বাংলাদেশে কেউ প্রাইস কমায় না, কেবল প্রফিট মেক্সিমাইস করে 😊 )
২। প্রাণ আর এফ এল বাংলাদেশের একটি বড় বিজনেস গ্রুপ, আর তাদের ফিল্ড ফোর্সের বিশাল একটা অংশ মোটরসাইকেল ব্যবহার করে। এদের সবাইকে TVS এর মোটরসাইকেল ব্যবহারে শিফট করানো যাবে। এটা একটা অটো সেল বলতে পারেন, যেটি সংখ্যাগত দিক দিয়ে যথেষ্ট বড়।
৩। প্রাণ আর এফ এল বাংলাদেশের বাজারে টিভিএস অটোমোবাইল বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে যেরকম সরাসরি প্রভাব বিস্তার করতে পারতো, সেটা Pran RFL এর মাধ্যমে করা সুযোগ বেশ কম। কেননা, এটি স্বতন্ত্র ও অনেক বড় একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের ভারতের বাজারেও বেশ শক্ত ব্যবসা অবস্থান রয়েছে।
সেইসাথে তাদের ফরেন নেগেসিয়েশন পাওয়ার ও কমিউনিকেশন অলরেডি রয়েছে। তাই বলা যায় প্রাণ আর এফ এল তাদের নিজস্ব স্ট্রাটেজি মেনেই ব্যবসা করবে। আর সেইসাথে উৎপাদনে গেলে তারা হয়তো ভারতের সেভেন-সিস্টার্স পার্টেও বাংলাদেশে উৎপাদিত বাইক রপ্তানি করবে ও ট্যাক্স বেনিফিট নিবে, যেটি করেছিলো Runner Automobile রানার মোটরসাইকেল নেপালে রপ্তানি করে।
তবে প্রাথমিক অবস্থা যা-ই হোক, শুভ কামনা রইলো প্রাণ আর এফ এল এর জন্য। আমরা বাংলাদেশের মাটিতে টিভিএস এর নতুন নতুন মোটরসাইকেলগুলো অচিরেই দেখতে চাই এবং প্রাণ আর এফ এল যাতে এদেশের বাইকারদের নিরাপত্তা ও রোড-সেফটি নিয়ে বেশি বেশি কাজ করে, আমাদের পক্ষ থেকে আন্তরিকভাবে সেই অনুরোধ রইলো। বাংলাদেশের বাইকার’রা অপেক্ষা করছে প্রাণ আর এফ এল এর অফিসিয়াল ঘোষণা এর জন্য, আশা করি খুব শিগ্রই তাদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটবে।
