মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন অয়েল নিয়ে জানা অজানা তথ্য
This page was last updated on 15-Nov-2025 02:44pm , By Badhan Roy
ইঞ্জিন অয়েল হলো একটি লুব্রিকেন্ট যা ইঞ্জিনের চলমান অংশগুলোর ঘর্ষণ কমিয়ে মসৃণভাবে চলাচল করতে সাহায্য করে। ইঞ্জিনের পরিচালনার জন্য ইঞ্জিন অয়েল অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু আমরা মোটরবাইকাররা অনেকেই ইঞ্জিন অয়েল রিলেটেড কিছু বিষয় নিয়ে দ্বিধায় ভুগি। যেমন- কোন ধরনের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা উত্তম, কত কি.মি পর পর ড্রেইন বা টপ আপ করা উচিৎ, কোন গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যাবহার করা ভাল ইত্যাদি।
আজকের লেখায় আমরা মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন অয়েল নিয়ে বিভিন্ন জানা অজানা তথ্য ও পরামর্শ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
মোটরসাইকেল ইঞ্জিন ওয়েলের জানা ও অজানা তথ্য

ইঞ্জিন অয়েল এর প্রধান কাজ
ইঞ্জিন অয়েল সম্পর্কে জানতে হলে এর প্রধান কাজ সম্পর্কে আমাদের আগে জানতে হবে। একটি ইঞ্জিন অয়েলের কার্যকারিতা কে আমরা ৫ ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-

লুব্রিকেশন: ইঞ্জিনের ভেতরের চলমান ধাতব যন্ত্রাংশের মধ্যে ঘর্ষণ কমিয়ে দেয় এবং ইঞ্জিনের রোটেশন মসৃণ করে।
কুলিং: রোটেশনের ফলে সৃষ্ট ঘর্ষণ থেকে উৎপন্ন তাপ কমাতে সাহায্য করে।

ক্লিনিং: ধুলাবালি, কার্বন, ধাতব কণা ইত্যাদি পরিষ্কার রাখে।
সিলিং: পিস্টন ও সিলিন্ডারের মধ্যে গ্যাপ সিল করে ইঞ্জিন কম্প্রেশন ঠিক রাখে।
প্রোটেকশন: ইঞ্জিনের ধাতব অংশের মরিচা ও ক্ষয় রোধ করে ইঞ্জিনকে দীর্ঘস্থায়ী করে।
ইঞ্জিন অয়েলের ধরণ
সাধারণত ইঞ্জিন অয়েল ৩ ধরণের হয়ে থাকে। যথা মিনারেল, সেমি-সিন্থেটিক ও ফুল-সিন্থেটিক।
মিনারেল অয়েল প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ও রিফাইন করা পেট্রোলিয়াম-বেসড লুব্রিকেন্ট যা ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে তৈরি করা হয়। সাধারণত নতুন বাইকের ব্রেক-ইন-পিরিয়ডে মিনারেল অয়েল ইউজ করা উত্তম। কারন ইঞ্জিনের ভেতরের পিস্টন, সিলিন্ডার ও ভালভের অংশগুলোকে ঠিকভাবে মসৃণ করা দরকার। মিনারেল অয়েলের দাম তূলনামূলক কম এবং মিনারেল অয়েলের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মিনারেল অয়েলের তাপ সহ্য ক্ষমতা কম হওয়ায় ইঞ্জিন দ্রুত গরম হয়। মিনারেল অয়েল কিছুটা বেশি ঘন হওয়াতে দীর্ঘসময় রাইডে ইঞ্জিনে প্রেশার পড়ে। মিনারেল অয়েলের ড্রেন পিরিয়ড কম হওয়ায় ঘন ঘন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়।
সেমি-সিন্থেটিক হচ্ছে মিনারেল অয়েল ও সিন্থেটিক অয়েলের মিশ্রণ, যা দুই ধরনের অয়েলের ভালো বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হয়। এই অয়েলগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ২০%–৩০% ফুল সিন্থেটিক বেস অয়েল মিনারেল অয়েলের সাথে মেশানো হয় এবং শুধু তাই নয়, এতে প্রয়োজনীয় অ্যাডিটিভ মিক্স করা থাকে ইঞ্জিনের সুরক্ষার জন্য। অনেকে বলে থাকেন মিনারেল থেকে সরাসরি সিন্থেটিক অয়েলে শিফট করার আগে সেমি-সিন্থেটিক ইঞ্জিন অয়েল ব্যাবহার করলে ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশগুলো অয়েলের টাইপের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে ভালভাবে। সেমি-সিন্থেটিকের ড্রেন পিরিয়ড মিনারেল থেকে বেশি এবং এর দাম সামান্য একটু বেশি। পারফর্মেন্স এর দিক থেকেও এটি মিনারেল থেকে ভাল। সহজ কথায় এটি মিনারেল এবং সিন্থেটিক এর মাঝামাঝি একটি ব্যালান্স পারফরমেন্স দেয়।
ফুল সিন্থেটিক ইঞ্জিন অয়েল হচ্ছে এমন এক ধরনের লুব্রিকেন্ট যা সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হয় এবং ইঞ্জিনের উচ্চতর পারফরম্যান্স, দীর্ঘস্থায়িত্ব ও তাপ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি সবচেয়ে উন্নতমানের ইঞ্জিন অয়েল হিসেবে বিবেচিত। এই অয়েলের অণু কাঠামোগুলো ৯৯% পর্যন্ত বিশুদ্ধ এবং অভিন্ন হয়ে থাকে। এই অয়েলগুলো স্মুথ ও হাই পারফর্মেন্স লুব্রিকেশনের জন্য বিশেষভাবে তৈরী এবং এর ড্রেন পিরিয়ড অনেক বেশি হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন ফুল সিন্থেটিক কেবল স্পোর্টস বাইক বা হাইয়ার সিসিতেই ব্যাবহার করা যায় যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যে কোন সিসি ও সেগমেন্টে নির্দিষ্ট গ্রেড অনুযায়ী ফুল সিন্থেটিক অয়েল ব্যাবহার করা যায় নিশ্চিন্তে। তবে এই ধরণের অয়েলের দাম অনেক বেশি হয়ে থাকে যা এর একটি সীমাবদ্ধতা হিসেবে ধরা যায়।
কত কিমিঃ পর পর ইঞ্জিন অয়েল ড্রেন দেওয়া উচিৎ?
বাংলাদেশের সাধারণ বাইকার এবং মেকানিকদের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত সেটি হচ্ছে প্রতি ৮০০-১০০০ কিমিঃ পর পর যে ধরণের ইঞ্জিন অয়েলই ইনসার্ট করা হোক না কেন পরিবর্তন করতে হবে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিকারক সিদ্ধান্ত বটে। আন্তর্জাতিক অটোমোবাইল বিশেষজ্ঞদের মতে ব্রেক-ইন-পিরিয়ড ব্যাতিত ঘন ঘন ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তনের খুব একটা দরকার নেই। তারা পরামর্শ দিয়ে থাকেন মিনারেল অয়েল ১৫০০-২০০০ কি.মি, সেমি-সিন্থেটিক ২৫০০-৩৫০০ কি.মি এবং ফুল সিন্থেটিক অয়েল ৪৫০০ থেকে ৬০০০ বা তার ও বেশি চালানো সম্ভব। নির্দিষ্ট সময় পর পর ইঞ্জিন অয়েলের লেভেল চেক করে যদি অয়েল লেভেল কম মনে হয় যতটুকু কমে ততটুকু অয়েল টপ-আপ করে ব্যাবহার করলে ইঞ্জিনের কোন প্রকার ক্ষতি হয় না। তবে খেয়াল রাখতে হবে এভাবে টপ-আপ করে সবসময় ব্যাবহার করা যাবেনা যদি না ইঞ্জিন অয়েলের ঘনত্ব বা ভিস্কোসিটি বিদ্যমান না থাকে। এমন হলে অয়েল পরিবর্তন করে ফেলা উচিৎ।
কখন বুঝবো ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করার সময় হয়েছে?
আমাদের অনেকেরই আসলে কি.মি হিসাব করে ইঞ্জিন অয়েল চেঞ্জ করা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অনেকে বিশ্বাস না ই করতে পারেন, কিন্তু আপনার বাইকই আপনাকে বলে দেবে কখন তার ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তনের সময় হয়েছে। অয়েল পাতলা বা কমে গেলে ইঞ্জিনে ঘর্ষণ বেড়ে যায় ফলে অস্বাভাবিক শব্দ হয়। এতে ইঞ্জিন অয়েল চেক করে প্রয়োজনে টপ-আপ বা ড্রেন দেওয়া যেতে পারে। অয়েলের রঙ কালচে ও পোড়া হয়ে যাওয়া লক্ষ্য করলে অয়েল পরিবর্তন করে ফেলতে হবে। অয়েল পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হচ্ছে ওভার হিটিং। একই সাথে নকিং, গিয়ার শিফটিং এ অসুবিধা হওয়া ও থ্রটল রেসপন্স কমে যাওয়ার সাথে পোড়া গন্ধযুক্ত কালো বা নীলচে ধোয়া লক্ষ্য করলে ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন করে ফেলা উত্তম।
বিশেষ সতর্কতা
বাইকের ব্র্যান্ড অনুযায়ী ইউজার ম্যানুয়ালে যে গ্রেড রেকোমেন্ড করা হয়েছে (যেমন- 10w40, 20w50) সেই গ্রেডের ইঞ্জিন অয়েল ব্যাবহার করাই উত্তম। এখানে w এর আগের ডিজিটগুলো দ্বারা ঠান্ডা অবস্থায় তরলের মান এবং পরের ডিজিটগুলো দ্বারা উত্তপ্ত অবস্থায় তরলের মান বোঝানো হয়ে থাকে। যদিও আবহাওয়ার সাথে গ্রেডের কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে তারপরেও গ্রেড পরিবর্তন না করাই উত্তম।
আরো একটি জরুরি সতর্কতা হচ্ছে বর্তমানে বাজারে মানহীন ইঞ্জিন অয়েলের পাশাপাশি নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর হুবুহু নকল ইঞ্জিন অয়েল পাওয়া যাচ্ছে। নকল ইঞ্জিন অয়েল ব্যাবহারে ইঞ্জিন ও ইঞ্জিনের প্রায় প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশের ক্ষতি হয় যা পরবর্তীতে একদিকে যেমন ইঞ্জিন নষ্ট করে ফেলে অপরদিকে চলন্ত অবস্থায় ইঞ্জিন সিজ করে মারাত্মক দূর্ঘটনার কারন হতে পারে। তাই বিশ্বস্ত শপ থেকে অথেনটিক ও অরিজিনাল অয়েল সংগ্রহ করার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।