বাইকারদের সুন্দরবনের রাসমেলা ভ্রমন
This page was last updated on 28-Jul-2024 05:40am , By Saleh Bangla
আমরা সকলেই সময় সুযোগ পেলেই হরহামেশাই কক্সবাজার ঘুরে আসি তাই না, কিন্তু সেই তুলনায় সুন্দরবন ঘুরতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হলেও, সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়ার নানান নিয়মকানুন আর অমূলক ভয়ের কারনেই অনেকের যাওয়া হয়ে ওঠে না । তবে অভিজ্ঞ কারো সাথে যাওয়াই ভালো। সুন্দরবন ঢোকার ব্যাপারে হরেক রকমের বাধ্যবাধকতা আর নিয়মকানুনের ঝামেলা পোহাতে হয় যা আমাদের জন্য খুব কষ্টদায়ক । অনেকেই আবার বাঘের ভয়ে সুন্দরবন যেতে চাননা। কিন্তু বাঘের এই আকালের সময়ে বাঘের দেখা পেয়েছেন এমন কারুর দেখা মেলাই ভার! তাই এইসবের চিন্তায় সুন্দরবনের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং রাসমেলা না দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মানেই হয় না।
বাইকারদের সুন্দরবনের রাসমেলা ভ্রমন
তাই তো আমরা ১১জন ৬টি মটর সাইকেল নিয়ে ২০.১১.২০১৮ ইং রোজ মঙ্গলবার বিকাল প্রায় ৪টার সময় রওনা করলাম ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বাইকার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে। ক্লাবের মেইন জোন নির্ঝর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজের সামনে থেকে ভাষানটেক বাজার ফুচকা মহল প্রাঙ্গন থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে রাসমেলা উপভোগ করতে। এই ট্যুরে আমাদের সাথে ছিলো ৩টা ফেজার বাইক, ১টা পালসার এনএস ১৬০, ১টা আরটিআর এবং ১টি আর ১৫ ভি২ বাইক। ভাষানটেক বাজার ফুচকা মহল প্রাঙ্গন থেকে প্রায় ৪ টার সময় রওনা করে যখন মংলা গেলাম তখন ঘড়িতে বাজে রাত ১১ টা। এর ভিতরেই সকল নৌকা ছেড়ে গিয়েছে দুবলার চরের উদ্দেশ্যে । আমাদের নৌকাটি শুধু ঘাটে ছিলো আমাদের জন্য । তারপর আমাদের ভাই বন্ধু শাহিন ভাই (টুরিস্ট পুলিশ) তার সহায়তায় আমাদের বাইক গুলো নিরাপদ স্থানে রাখলাম এবং আমাদের ১১ টি হেলমেট ও ১১ জোড়া সেফটি গার্ড ঐ জায়গার এক ব্যবসায়ী স্বপন ভাইয়ের দোকানে রাখলাম ।
তার সম্পর্কে একটু বলে রাখি গতবার যখন সুন্দরবন গিয়েছিলাম তখন এই ভাইয়ের সাথে দেখা হয় এবং পরিচয় হয়। স্বপন ভাই খুব হেল্পফুল একটা মানুষ । তারপর তাড়াহুড়া করেই নৌকায় উঠলাম। ক্লান্ত শরীরে কোন রকম হাত মুখ ধুয়ে বসে পরলাম নৌকার ছাদে হালকা শীতল হাওয়া শরীরকে শীতল করে দিচ্ছিলো আর মনে আসছিলো এই সুরটা এই পথ যদি শেষ না হয় তবে কেমন হতো আপনি বলেন তো ? রাতে নৌকায় খিচুড়ি রান্না করা হয়েছে মুরগি দিয়ে যাই হোক আলহামদুলিল্লাহ সবাই একসাথে বসে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। শুরু হলো আমাদের দুবলার চর যাওয়ার মিশন নৌকায় করে, আমরা সবাই অনেক উল্লাসিত ছিলাম কারন এই প্রথম এই রকম একটা ট্যুর দিচ্ছি ।
নৌকা কিছু দূর গিয়ে থেমে গেলো আর দেখতে পেলাম শত শত নৌকা এক জায়গাতেই, তখন তাদের জিজ্ঞাস করতেই জানলাম সকল নৌকা এইখানে সমবেত হয়েছে দুবলার চরে যাওয়ার পারমিশন নেওয়ার জন্য। এই সিরিয়াল আর নৌকার জ্যাম দেখে বিরক্ত লেগে গেলো । কখন যে পারমিশন হবে, যাই হোক আমাদের নৌকা চালক জুয়েল ভাই বললো আচ্ছা আমরা সামনে চলে যাই ঐ খান থেকেও পারমিশন নেওয়া যাবে, নৌকা আবার চলতে লাগলো আর সকল নৌকা ঐ খানেই রয়ে গেলো শুধু আমাদের নৌকাটি চলতে লাগলো তবে তা বেশি দূর চলতে পারলো না ।
এবার আমরা চলে আসলাম পারমিশন নেওয়ার আরেকটি পয়েন্টে। তবে এই বার আর গতি নেই সকাল ৬টা অব্দি এই খানেই থাকতে হবে, ওরা বলে দিলো ৬টার আগে পারমিশন পাওয়া যাবেনা । তাই সকলেই একসাথে মজামাস্তি করতে করতে রাত ৩ঃ৩০ বেজে গেছে আর দেরি করতে পারলাম না শুয়ে পরলাম আমাদের নেওয়া লেপ, বালিশ, কাথা নিয়ে । যখন ঘুম ভাংলো তখন বাজে ৭টা আর দেখতে পাচ্ছি বোট ও চলছে ফুল দমে, জিজ্ঞাস করলাম ভাই পারমিশন কি পেয়েছিলেন ৬টার সময়ে, উত্তর আসলো না ভাই, কারন ঐ খানেও শত শত বোট জড়ো হয়ে ছিলো পারমিশনের জন্য।
যদি পারমিশনের জন্য ঐ সিরিয়ালে থাকতাম তাহলে আজকের দিন ও চলে যেতো পারমিশন নিতেই, তাই জুয়েল ভাই পারমিশনের তোয়াক্কা না করেই চলে আসলো। যাই হোক আমরা যখন দুবলার চরে পৌছালাম তখন বাজে প্রায় দুপুর ১টা তবে তার আগেই নদীর এক কিনারায় সকালের খাবার খেয়ে নিলাম। আসলে কি যারা এই রকম ট্যুরে জাননি তাদের বুঝতে একটু কষ্ট হবে যে, এটা একটা অদ্ভুত রকমের ট্যুর ছিলো । কিছু সময়ের ভিতরেই নেমে পরলাম গোসলের জন্য লোনা পানিতে, যদিও আমাদের ভিতর দুই এক জন লোনা পানিতে নামেনি ।
তারপরও একটা মজার সময় অতিবাহিত করলাম লোনা পানি আর ছবি তোলার মধ্য দিয়ে । দুপুরের খাবারের পর্ব টা শেষ করলাম ফাইসসা মাছ দিয়ে। কিসের বিশ্রাম, কেও আর বিশ্রাম নিতে চাইলো না। বাবু সেজে সবাই নেমে পরলাম বিচে, এবার আমাদের গন্তব্য রাসমেলা, আমরা যেখানে নামলাম ঐ খান থেকে রাসমেলা যেতে পায়ে হেটে সময় লাগবে ১ ঘন্টা আর যদি আমরা আবার নৌকায় উঠে মেলার নিকটতম ঘাটে যাই তাহলে মেলায় যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩ মিনিট।
তাই নিজেরাই বললাম না আমরা বিচ ঘেসে হাটতে থাকি এটাই মজা হবে তাই আর নৌকার তোয়াক্কা না করে হাটা শুরু করলাম।একটা সময় পরে রাসমেলা তে পৌছে গেলাম তবে তখনো মেলা তখন সেই রকম ভাবে জমে উঠেনি । যাই হোক সবাই মেলার ঐতিহ্যবাহী পান খেলাম, সত্যি ঐ পানের কথা অনেক দিন মনে থাকবে, তারপর চা, ডাব, পাপরি, চিপস, ইত্যাদি খেতে খেতে সময় টা ভালোই কাটছিলো আর দেখতেই দেখতেই ঘড়ির কাটায় তখন প্রায় রাত ৯ঃ২০।
এখন ক্লান্ত শরীরে । এখন নৌকায় ফেরার পালা চলে গেলাম বোটওয়ালার নির্ধারিত জায়গায় । কিন্তু ঐখানে গিয়ে তাকে পেলাম না ঘন্টা তিনেক তাকে খোজাখোজি করে প্রায় ১টার সময় তাকে পেলাম এবং আর দেরি না করে বোটে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পরলাম তবে তার আগেই বোটওয়ালাকে বললাম আমাদের সকালেই হিরন পয়েন্টে নিয়ে জেতে উনি রাজি ও হলো তবে আমরা আরো প্লান করলাম সকালে দুবলার চর থেকে রওনা করে হিরন পয়েন্টে এই দিনটা কাটিয়ে বিকাল বা সন্ধ্যা নাগাদ করমজলের উদ্দেশে রওনা করবো।
সব ঠিক ঠাক ছিলো, ২২.১১.২০১৮ সকালে ঘুম ভাংতেই দেখছি আমাদের নৌকা চলতে লাগলো, না না হিরন পয়েন্টের দিকে নয়, ঔখানে জেতে নাকি পারমিশন নিতে হয় কিন্তু বোট যখন ঘাটে ভিরলো আর ওনারা নেমে কিছুক্ষন পরে ফিরে এসে বললো এখন পারমিশন দিবে না দুপুরে দিবে, আচ্ছা ঠিক আছে আমরা আবার চলে গেলাম একটু সামনে যে খানে শুটকির দোকান গুলো আছে সেই খানে। অনেকেই নেমে পরলো শুটকি কিনতে আর আমি বসে বসে স্পিড খাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন পরে আমাদের সকলেই ফিরে আসলো ব্যাগ নিয়ে বুঝলেন । শুটকির ব্যাগ নিয়ে তবে ব্যাতিক্রম ছিলাম আমি আর নাজিম। এবার বোটওয়ালা বলে উঠলো যেহেতু হিরন পয়েন্টে যাবেন তাই চলেন আবার যাই পারমিশন নিতেই হবে ঐখানে পারমিশন ছাড়া যাওয়া যাবে না।
আমরা বললাম ভাই যেটা ভালো হয় সেটাই করেন আর তখনি যে কাধে শনি ভর করবে কে ভেবেছিলো। বোট ঘাটে ভিরলো আর বোটওয়ালা জুয়েল ভাই পারমিশনের জন্য চলে গেলো আর ফিরলো ২০ মিনিট পরে ততক্ষনে আমাদের আর যাওয়ার উপায় নাই কারন বোট চরে আটকে গেছে একটু আগেও যেখানে অনেক পানি ছিলো এখন সেইখানেই ১ ফিট পানিও নাই বললেই চলে, কি দারুন প্রাকৃতিক দৃশ্য বলে বোঝানো যাবেনা।
এবার আমরা চিন্তা করলাম যদি জোয়ারের পানি আসতে দেরি করে তাহলে আর হিরন পয়েন্টে যাবো না কারন যে ভাবেই হোক আমাদের ২৩.১১.২০১৮ ইং সকালের ভিতর ই করমজল থাকতে হবে তাই এই বার আর হিরন পয়েন্টের আশা ছেড়েই দিলাম। আর কি করার আবার রাসমেলা তে রাত ৮টা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করলাম তবে মূল আকর্ষণ নাকি রাত ৩টা থেকে শুরু হয়, গান বাজনার সাথে সাথে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা গঙ্গাস্নান করতে যায় সমুদ্রের বিচে ঐখানেই নাকি তারা মুরগি, বিভিন্ন ধরনের ফল ইত্যাদি সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয় এটা নাকি তাদের প্রার্থনার একটা অংশ, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যদি কোন ভুল বলে থাকি তাহলে আমাকে জানাবেন আমি সংশোধন করে নিবো।
তবে আফসোস আমরা এই অংশটা দেখতে পারলাম না। আমাদের বোট রওনা করলো রাত ৮টার সময় তবে মজার ব্যাপার হলো সমুদ্রের বুক চিরে শুধুমাত্র আমাদের বোটটিই চলছে আর মাঝে মাঝে দুরপ্রান্তে দেখা মিলে বড় বড় জাহাজের, কি ছিলো না এই ট্যুরে নদীর শান্ত মনোভাব সাথে অশান্ত হয়ে উঠাও বড় বড় ঢেউ মনে দাগ কেটে যায়। রাত যখন প্রায় ২ টা তখন আমাদের বোট চলে এসেছে করমজলে, এখন শুধু ভোর হবার অপেক্ষা ভোর হতেই আমরা চলে গেলাম করমজলের ভিতরে।
যেতেই দেখা মিললো বানরের সাথে, বানর গুলোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো তারা ছিলো ক্ষুধার্ত । যাই হোক আমরা কিছু বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই খাওয়ালাম আর একটু সামনে যেতেই মিললো হরিনের দেখা । তাদের দেখে তো আরো অবাক হলাম মনে হচ্ছে তাদের কোন খাবারই দেওয়া হয় না কোন খাবারের অস্তিত্ব ও নাই। করমজলের কর্মচারী দুই একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে, বানরের জন্য নাকি কোন বাজেট হয় না আর হরিনের জন্য যেই বাজেট হয় তা চলে যায় বড় হায়নার বাসায়।
করমজল দেখে চলে আসলাম মংলা ঘাটে তখন বাজে সকাল ১০ টা, তবে তার আগে আশার পথে দেখতে পেলাম একটা ছোট্ট পাড়া সেই খানে দিয়ে আসলাম আমাদের কারো কারো কম্বল খানা। তারপর চললো জম্পেশ খাওয়া দাওয়া কারন মনে হচ্ছে অনেক দিন পরে মাটিতে ফিরলাম। প্রায় দুপুর ১২ টার সময় রওনা করলাম ঢাকার উদ্দেশে তারপর ধুলোবালির রাজত্বে চলে আসলাম।যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বাইকারর্স ক্লাবের মেইন জোনে আসলাম তখন বাজে রাত ৮ঃ৩০।
এই ছিলো একটি প্রাণবন্ত সুন্দরবনের রাসমেলা ভ্রমন ইতিকথা । পরিশেষে বলতে চাই প্রকৃতির টানে আমরা যে যেখানেই ঘুরতে যাইনা কেনো সবাই একটা বিষয় খেয়াল রাখবো যেন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট না হয়, এবং এই রুপ কোন কাজ যেন আমাদের দ্বারা না হয় সে দিকটাও খেয়াল রাখব। ধন্যবাদ সবাইকে।
লিখেছেনঃ Rofiqul Islam
আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com – এই ইমেইল এড্রেসে।