কম খরচে কেরানীগঞ্জের ৩ টি দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ - ভ্রমণ টিপস
This page was last updated on 01-Aug-2024 03:33pm , By Ashik Mahmud Bangla
ভ্রমণ টিপস এর আজকের পর্বে আমি আপনাদের সাথে কম খরচে কেরানীগঞ্জের ৩ টি দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করবো। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পর থেকে অনেকের পক্ষেই এখন আর চাইলেই লং ট্যুর করা সম্ভব হবে না। আমরা যারা নিজে ইনকাম করে বাইক ব্যবহার করি তারা এই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছি যে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করার ফলে কতটা সমস্যা হচ্ছে। যারা ঢাকায় বসবাস করেন তারা খুব সহজেই এই জায়গাগুলো থেকে কম খরচে ঘুরে আসতে পারেন।
কোথাও ভ্রমণ করতে গেলে সেই জায়গা সম্পর্কে আমাদের সবার জানা উচিৎ। ভ্রমণ থেকে আপনি এমন অনেক কিছু জানতে এবং শিখতে পারবেন যা আপনার চলার পথে অনেক কাজে লাগবে। সবার প্রথমে কেরানিগঞ্জের ইতিহাস কিছুটা জেনে নেয়া যাক।
কেরানীগঞ্জের ইতিহাসঃ
কেরানীগঞ্জ নামকরণের পেছনে যে দুটি সম্ভাব্য ঐতিহাসিক ঘটনাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয় তার পেছনে ইতিহাস ভিত্তিক কোন শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় নি। নবাব শায়েস্তা খানের শাসনামলে নবাবের পাইক-পেয়াদা এবং কেরানীরা বুড়িগঙ্গার ওপারে থাকতেন। এজন্য ধারণা করা হয় এই কেরানীদের নামানুসারে কেরানীগঞ্জের নামকরণ হয়েছে। এছাড়া ভিন্ন একটি মত অনুসারে, মোগল আমলে ঢাকার তৃতীয় গভর্নর ইব্রাহীম খাঁনের দুজন কর্মচারী বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে বসবাস করতেন। সে থেকে এ এলাকার নাম কেরানিগঞ্জ নামকরণ করা হয়।
কেরানীগঞ্জ দ্বীপাকার বলে মোঘল আমলের এক পর্যায়ে এই স্থানের নাম হয় পারজোয়ার। কেরানীগঞ্জের উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে রয়েছে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিম- দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে ধলেশ্বরী । মোঘল আমলে ধলেশ্বরী নদীর নাম ছিল ঢল সওয়ার। জোয়ার শব্দের অর্থ অঞ্চল এবং পার শব্দের অর্থ তট। সম্ভবত এই জন্যই মোঘল আমলে এই এলাকার নাম রাখা হয়েছিল পারজোয়ার যা আজও কেরানীগঞ্জের ছোট একটি এলাকার নাম হিসেবে বিদ্যমান।
ঐতিহাসিকভাবে ১৭৫৭ সালে শাসক পরিবর্তনের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী এবং তার এক খালা কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরাতে কারাবন্দী ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কৌশলগতভাবে বিশেষত গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে কেরানীগঞ্জ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকা শহরে পরিচালিত অধিকাংশ গেরিলা যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনা করা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে এবং এজন্য অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। পাকিস্থানী সেনারা কোনাখোলা,বাস্তা, ব্রাক্ষ্মণকৃর্থ, ঘাটারচর, মনোহরিয়া, জয়নগর, গোয়ালখালি, খাগাইল ও খোলামোড়ার বহু বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গেরিলারা পরবর্তীতে এখান হতে পাকিস্থানী সেনাদের ওপরে ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ চালায়।
কেরানীগঞ্জ সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্যঃ
ঢাকার মোহাম্মদপুর , হাজারীবাগ ও লালবাগ থানা, পূর্বে নারায়গঞ্জ সদর ও লৌহজং উপজেলার অংশ বিশেষ, দক্ষিণে সিরাজদিখান ,উপজেলা এবং পশ্চিমে নবাবগঞ্জ এবং সিংগাইর উপজেলা নিয়ে কেরানীগঞ্জ গঠিত। জেলা সদর হতে কেরানীগঞ্জ এর দূরত্ব ১৫কি:মি: ।
কেরানীগঞ্জের ৩ টি দর্শনীয় স্থান- ভ্রমণ টিপস
১- সারিঘাটঃ
কেরানীগঞ্জের যে জায়গাটা আমার অনেক পছন্দের সেটা হচ্ছে সারিঘাট। এই জায়গাটা হচ্ছে বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রোজেক্টের পেছনের একটি স্থান। যা আইন্তা ও আড়াকুল গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খালের অংশবিশেষ। খালের পাশ দিয়ে সারি ধরে করই গাছ আছে। এ কারণেই জায়গাটি সারিঘাট নামে বেশি পরিচিত। খালের নব্যতা বাড়াতে ড্রেজিং করা হয়েছিল ও রিভার প্রজেক্টের বালু আড়াকুল গ্রামের দিকে ফেলার কারণে এখানে শরৎকালে বিস্তীর্ণ কাশবন দেখা যায়।
খাল-বিল আর গাছপালার কারণে সেখানকার পরিবেশ অনেকটাই গ্রামীণ। আমি যতবার বাইক নিয়ে এখানে গিয়েছি মনে অন্য রকম একটা প্রশান্তি পেয়েছি। এখানে এলে খালের ধারে দেখা মিলবে প্রায় কিলোমিটার পর্যন্ত গাছের সারি , একইসঙ্গে কিছু অস্থায়ী খাবারের দোকানও পাবেন। কাশবন ছাড়াও সারিঘাটে পাবেন , কায়াকিং ও নৌ ভ্রমণের সুযোগ। সারিঘাটের শুরুতেই পড়বে কায়াকিং, ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা। বিকেল বেলা ভিড় থাকে, তাই কায়াকিং করতে চাইলে পর্যাপ্ত সময় হাতে নিয়ে যাবেন। নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে চাইলে অবশ্যই আগে থেকে দামাদামি করে নিবেন।
সারিঘাট কিভাবে যাবেন ?
আপনি আপনার বাইক নিয়ে দুইটা রাস্তা দিয়ে সারিঘাট যেতে পারেন। প্রথমত আপনি বছিলা ব্রিজ পার হয়ে গ্রামের মধ্যে মাওয়ার রাস্তা দিয়ে সারিঘাট যেতে পারেন। আর যদি এই রাস্তা দিয়ে আপনার ঝামেলা মনে হয় সেক্ষেত্রে আপনি বাইক নিয়ে যাত্রাবাড়ী এসে সেখান থেকে পোস্তাগলা ব্রিজ পার হয়ে খুব সহজেই সারিঘাট আসতে পারবেন।
কেরানীগঞ্জের সারিঘাট যাওয়ার জন্য ঢাকার যে কোন জায়গা প্রথমে যাত্রাবাড়ী আসতে হবে। সেখান থেকে জুরাইন রেল গেইট আসবেন, বাস বা লেগুনাতে ভাড়া ৮ টা। জুরাইন রেল গেইট থেকে পোস্তগলা ব্রিজ পার হতে হবে। পোস্তাগলা ব্রিজ পার হলেই সারিঘাট যাওয়ার অটোরিক্সা বা সিএনজি পেয়ে যাবেন। লোকাল সিএনজিতে ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা।
লোকাল সিএনজির ঝামেলায় যেতে না চাইলে জুরাইন রেল গেইট থেকে সিএনজি রিজার্ভ নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ১২০ টাকা। যেহেতু এখন সব কিছুর ভাড়া বেড়ে গেছে সেক্ষেত্রে আপনার খরচ কিছুটা বাড়বে।
২- সাউথ টাউন কেরানীগঞ্জঃ
কেরানীগঞ্জের সাউথ টাউন মসজিদ অনেক আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিলো , চারপাশে কাঁশফুল ঘেরা একটা অসাধারণ স্থাপনা। কেরানীগঞ্জের সাউথ টাউন আবাসিক প্রকল্পের মধ্যে অবস্থিত এই মসজিদ। নান্দনিক গঠন আর অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর কারণে মসজিদটি এরই মধ্যে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় রুপে ধরা দিয়েছে। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের কর্ণধার মোস্তফা কামাল মঈনুদ্দিন হচ্ছেন এর উদ্যোক্তা। মসজিদটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছে প্রায় ২ বছর। আধা বিঘা জমিতে নির্মিত হয়েছে মসজিদটি।
চারপাশের খোলামেলা জায়গার মাঝে মাথা উঁচু করে নিজ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটি। মসজিদের নান্দনিকতার খবর পেয়ে অনেকেই ঢাকা থেকে এখানে ছুটে আসেন। চারদিকে তাকালে দেখতে পাবেন বড় বড় ঘাস আর বিশাল মাঠ , কিছু দূরে তাকালে দেখতে পাবেন ইটভাটা। স্থপতির নন্দন ভাবনার শৈলী ফুটে আছে গম্বুজের ভেতরের অংশেও। সন্ধ্যায় যখন মসজিদের চারপাশের লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয় , তখন অনেক বেশি সুন্দর লাগে এই জায়গাটি।
সাউথ টাউন কীভাবে যাবেন ?
সবার প্রথমে আপনাকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে আসতে হবে , এরপর রাজেন্দ্রপুর যেতে হবে। রাজেন্দ্রপুরের নতুন কারাগারের একটু পরে হাতের ডান দিকেই সাউথ টাউন প্রকল্প। এই আবাসন প্রকল্পের প্রধান ফটক থেকে ভেতরে ঢুকতেই দূর থেকে চোখে পড়বে এই মসজিদ।
৩- দোলেশ্বর হানিফিয়া জামে মসজিদঃ
আপনি জানলে অবাক হবেন দেড় শত বছরের বেশি সময় ধরে কালের সাক্ষী হয়ে আছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ। ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি পেয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর স্বীকৃতি।১৮৬৮ সালে মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু করেন দারোগা আমিন উদ্দীন আহম্মদ। তাই এর পরিচিত ছিলো ‘দারোগা মসজিদ নামেও’। বংশ পরম্পরায় মসজিদটির নির্মাণ ও সংস্কারকাজে নিয়োজিত ছিলেন খিদিরবক্স ও কাদের বক্স নামে দুই ভাই এবং মইজ উদ্দিনের পরিবার।
মসজিদটির মাঝখানে রয়েছে দুইটি গম্বুজ , চারপাশে রয়েছে তিনস্তর বিশিষ্ট ৮ টি মিনার এবং এর শীর্ষে রয়েছে ছোট গম্বুজ। এর বাইরেও বাকি ১২ খুঁটির উপরিভাগে রয়েছে অনেক সুন্দর কারুকাজ। দেড় শত বছরের পুরনো আদল ধরে রেখে নবাবি আমলের ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কারকাজ করা হয়েছে। মসজিদের ভেতরে রয়েছে দুটি মেহরাব , স্থানীয়দের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে, এমনকি দেশ–বিদেশ থেকেও পর্যটকেরা কেরানীগঞ্জের মসজিদটি দেখতে আসেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অনন্য এই স্থাপনা নিয়ে একাধিকবার ফিচার হয়েছে।
দোলেশ্বর হানিফিয়া জামে মসজিদ কীভাবে যাবেন ?
ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ ধরে সহজেই যেতে পারবেন দোলেশ্বর হানাফিয়া জামে মসজিদ কম্পলেক্সটি দেখতে। পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে নেমে চলে আসতে পারেন (দোলেশ্বর) মসজিদে।
কেরানীগঞ্জের ৩ টি দর্শনীয় স্থান নিয়ে আমরা জানতে পারলাম, এখন ব্যাপার হচ্ছে বাইক ট্যুরের এই খরচটাকে কিভাবে কমানো যায় ? চলুন তাহলে এই ট্যুরটা কিভাবে কম খরচে দেয়া যায় সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
বাইক ট্যুরের খরচ কমানোর উপায়ঃ
১- ট্যুরে যাওয়ার সময় নিজের সাথে কোন পিলিয়ন নিতে পারেন , পরিচিত এমন কাউকে নিয়ে যান যার ভ্রমণ করতে আপনি কম্ফোর্টেবল ফিল করেন। এতে করে বাইকের খরচ দুজন মিলে দিলে ট্যুরের খরচ অনেকটায় কম আসে।
২- গ্রুপ ট্যুর করুন , যখন লোক বেশি হবে তখন ট্যুরের খরচ এমনিতেও কমে যাবে। তবে গ্রুপ ট্যুরে অবশ্যই গ্রুপ রাইডের নিয়ম মেনে ট্যুর করুন।
৩- একটা নিদিষ্ট গতিতে বাইক চালান , আর বাইক থেকে ভালো মাইলেজ পেতে যে সব নিয়ম মানা উচিৎ সেগুলো মেনে চলুন।
FAQ:
১- ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ কত কিলোমিটার ?
উত্তরঃ ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ এর দূরত্ব ১৬.৫ কিলোমিটার।
২- ঢাকার দর্শনীয় স্থান কি কি আছে ?
উত্তরঃ ঢাকার দর্শনীয় স্থান অনেক আছে , এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
সব সময় নিয়ন্ত্রিত গতিতে বাইক রাইড করুন , বাইক রাইডের সময় লুকিং গ্লাসের দিকে অবশ্যই নজর রাখুন। বাইক পিলিয়ন নিয়ে রাইড করলে অবশ্যই পিলিয়নের দিকে খেয়াল রাখুন কারন দুজনের যে কোন একজন ভুল করলেই দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তথ্যসূত্রঃ জনতার দর্পন , সময়ের আলো , উইকিপিডিয়া , বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।