মোটরসাইকেলের ফুয়েল ট্যাংক এর মরিচা সমস্যা – কারন ও প্রতিকার
This page was last updated on 17-Nov-2025 03:54pm , By Badhan Roy
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বাইকারদের মধ্যে আলোচনা এবং দুশ্চিন্তার অন্যতম একটি কারন হলো মোটরসাইকেলের ফুয়েল ট্যাংক এর মরিচা সমস্যা। সাম্প্রতিক সময়ে এই সমস্যাটি এদেশে ব্যাপক আকারে দেখা যাচ্ছে এবং কোন নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড বা নির্দিষ্ট মডেলের বাইকে নয় বরং কম বেশি সব ধরণের ব্র্যান্ড এবং সেগমেন্টের মডেলে এই সমস্যা দেখা যাওয়ায় বাইকাররা ব্যাপক ভাবে চিন্তিত।
যদিও মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এই সমস্যাটি অনেকেই তাদের ওয়ারেন্টি পলিসির আওতায় এনে ফুয়েল ট্যাংক পরিবর্তন করে দিচ্ছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে পরবর্তীতে অনেকেরই একই সমস্যা আবার হচ্ছে। মরিচা এর কারনে বাইকের ট্যাংক এর পাশাপাশি ফুয়েল সিস্টেমেও বেশ প্রভাব পড়ে যা পরবর্তীতে বাইকের আরো বড় ধরণের ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়।
আজ আমরা একটি কেস স্টাডি আকারে এই সমস্যার সম্ভাব্য কারন ও প্রতিকার তুলে ধরার চেষ্টা করব।


মোটরসাইকেলের ফুয়েল ট্যাংক এর মরিচা ধরার সমস্যা - কারনসমূহ
কথায় আছে, লোহাকে খুব সহজে ক্ষয় করা সম্ভব না কিন্তু লোহা তার নিজের ক্ষয় নিজেই করে। মোটরসাইকেলের ফুয়েল ট্যাংকে মরিচা (rust) পড়ার মূল কারণ হলো ধাতুর সঙ্গে পানি ও অক্সিজেনের বিক্রিয়া (oxidation)। এই মরিচা ধরার কারনে লোহার গঠনগত পরিবর্তন হয় এবং লোহা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে। ফুয়েল ট্যাংক এ মরিচা ধরার ব্যাপারটিকে বেশ কয়েকটি কারনে ভাগ করা যেতে পারে।
১) আদ্রতা থেকে - বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারনে এই অঞ্চলের আবহাওয়া আদ্রতা পূর্ণ। আদ্রতার কারনে গ্রীষ্মকালে বাইক রাইড করে আসার পরে যখন আমাদের ফুয়েল ট্যাংক গরম থেকে ঠান্ডা হয় কিংবা বৃষ্টি বা শীতের সময় পরিবেশ কিছুটা ঠান্ডা থাকে তখন ট্যাংক এর ভেতরের দিকে ঘনীভবন (condensation) হয়ে জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হতে পারে আর সেখান থেকে মরিচা তৈরি হতে পারে।

অধিকাংশ বাইকার ট্যাংকে স্বল্প পরিমাণের অর্থাৎ ১০০-২০০ টাকার জ্বালানী ভরে থাকেন যা কিনা ফুয়েল ট্যাঙ্কের তলায় পড়ে থাকে। ফলে এতে ট্যাংক এর অধিকাংশ জায়গা ফাকা থাকার কারনেও ঘনীভবন সৃষ্টি হতে পারে।
২) ট্যাংক এ পানি প্রবেশ করার কারনে- অতি বৃষ্টি অথবা হাই প্রেশার ওয়াশ করার সময় কোন কারনে যদি ফুয়েল ক্যাপ দিয়ে ট্যাংক এ সামান্যতম পানি ও প্রবেশ করে তবে সেখান থেকেও মরিচা এর সূত্রপাত হতে পারে।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুইটি সবচেয়ে সাধারণ কারণ বলে বিবেচনা করা গেলেও প্রশ্ন আসে- তাহলে এতদিন আমাদের পুরাতন মডেলের বাইকগুলোতে এই ধরণের সমস্যা এত ব্যাপক আকারে দেখা যায় নি কেন? সুতরাং এক্ষেত্রে আরো কিছু কারণ রয়েছে। তো অন্যান্য কারন গুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাক তাহলে।
৩) জ্বালানীর ভেজাল- বাংলাদেশের অধিকাংশ ফিলিং স্টেশন গুলোর জ্বালানীর মান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রায়ই খোলা তেল এবং অনেক পেট্রোলপাম্প গুলোর ফুয়েলে ভেজালের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় যা বর্তমান সময়ে আরো বেড়েছে। তৃতীয় কারন হিসেবে জ্বালানীর ভেজাল কে দায়ী করা যেতে পারে।
যদিও অনেকের ধারনা বিশ্বের অনেক স্থানের মত বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে ইথানল মিশ্রিত E20 ফুয়েল বিক্রি করা হচ্ছে কিন্তু এখন পর্যন্ত এ তথ্যের প্রমাণ বা সত্যতা পাওয়া যায় নি। তাই বাংলাদেশের বাইকগুলোতে মরিচা পড়ার সমস্যার ক্ষেত্রে এই বিষয়কে দায়ী করা যাচ্ছে না।
৪) নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যাবহার করে ফুয়েল ট্যাংক তৈরি- অনেকের ধারণা কোম্পানি গুলো বর্তমানে বাইকের ট্যাংক এর কাঁচামাল নিম্নমানের ধাতব দ্বারা তৈরি করছেন ফলে সহজেই মরিচা ধরছে। এই যুক্তি টি আংশিক সত্য হলেও দেখা যাচ্ছে যে ৫-১০ বছর বা তার ও বেশি বয়সের বাইকের ট্যাংক এও এতদিন ধরে কোনরকম সমস্যা না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ গত ১-১.৫ বছর থেকে মরিচা ধরার সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে।
৫) বাইকের ফুয়েল ট্যাংক এর এন্টি রাস্ট কোটিং নষ্ট হয়ে যাওয়া- আরেকটি যৌক্তিক কারন হিসেবে বাইকের ফুয়েল ট্যাংক গুলোর এন্টি রাস্ট কোটিং বিভিন্ন কারনে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারনেও মরিচা ধরার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
শখের বাইকটি বেশ দামী হওয়ার কারনে একজন বাইকারের পক্ষে এই ধরণের সমস্যা মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর। তাছাড়াও বাইকের ফুয়েল ট্যাংক এর মরিচা কেবল সৌন্দর্য ও জ্বালানীর ধারণক্ষমতাই নষ্ট করে না বরং এই মরিচা আরো ময়লা আকৃষ্ট করে আর এই মরিচা ও ময়লা জ্বালানীর সাথে মিশে সময়ের সাথে সাথে বাইকের ফুয়েল সিস্টেম (কার্বোরেটর এবং ফুয়েল ইঞ্জেক্টর উভয়ই) সহ ইঞ্জিনের ক্ষতি করার পাশাপাশি বাইকের অন্যান্য মেটাল পার্টেও মরিচা ছড়িয়ে দিতে পারে।
তাহলে এই সমস্যার প্রতিকার বা প্রতিরোধের উপায় কি?
এই সমস্যার প্রতিকার বা প্রতিরোধের জন্য কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে-
১) বাইকে সবসময় ভাল জায়গা থেকে ভাল মানের অকটেন সংগ্রহ করতে হবে এবং অকটেন বুস্টার ব্যাবহার করা যেতে পারে।
২) চেষ্টা করতে হবে বাইকের ফুয়েল ট্যাংক সবসময় ফুল করা সম্ভব না হলেও অন্ততঃ অর্ধেক লেভেল পর্যন্ত যাতে তেল থাকে। এতে করে জলীয় বাষ্প তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
৩) বাইক সবসময় ছায়াযুক্ত স্থান, ছাউনি বা কাভারের নিচে রাখা যেতে পারে।
৪) খেয়াল রাখতে হবে ওয়াশ বা বৃষ্টির পানি যেন কোনভাবে ট্যাংক এর ভেতরে না যায়।
৫) নিয়মিত সার্ভিসিং এর সময় ট্যাংক পরিক্ষা এবং সব ফুয়েল বের করে ভালভাবে পরিষ্কার করে দীর্ঘ সময় রোদে শুকানো যেতে পারে।
৬) যদি মরিচা কোনভাবে ধরেই যায় সেক্ষেত্রে সাদা ভিনেগার এবং বেকিং সোডার মিশ্রণ খালি ট্যাংক এ ১২-২৪ ঘন্টা রেখে দিয়ে মরিচা পরিষ্কার করা যেতে পারে অথবা বর্তমানে অনেক স্থানে বাণিজ্যিক ভাবে ফুয়েল ট্যাংক এর মরিচা পরিষ্কার করা হচ্ছে তাদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
৭) এন্টি রাস্ট কোটিং করিয়ে নিতে পারলে অথবা ফাইবার মেড ফুয়েল ট্যাংক ব্যবহার করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়।
সবশেষে বলা যায়, ফুয়েল ট্যাংক এর মরিচা ধরার সমস্যা বর্তমানে ব্র্যান্ড নিউ বাইক থেকে শুরু করে পুরাতন সব রকম বাইকেই কম বেশি যেহেতু দেখা যাচ্ছে আর কারন যেটাই হোক নিজেদেরকেই যতটা পারা যায় প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
বাইক ও বাইক বিষয়ক সকল তথ্য ও পরামর্শের জন্য বাইকবিডির সাথেই থাকুন।