কেন বাংলাদেশে বাজাজ পালসারের জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে?
This page was last updated on 16-Sep-2025 11:01am , By Arif Raihan Opu
বাংলাদেশের মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রি গত কয়েক দশকের উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে আজকের মোটামুটি পরিনত একটি জায়গায় এসে দাড়িয়েছে। বর্তমানে অনেক প্লোবাল মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা বাংলাদেশের বাজারে অত্যন্ত সরব এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে একটা সময় ছিলো যখন আমাদের মোটরসাইকেল মার্কেটের সবকিছু এমনটা ছিল না।

সময়ে সময়ে অনেক মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড এদেশে পরিচালিত হয়েছে। আবার বেশকিছু মোটরসাইকেল মডেল বাংলাদেশের মোটরসাইকেল মার্কেটকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে। এদেশের মোটরসাইকেল হিস্ট্রিতে সেই মডেলগুলো সবসময়েই সমুজ্জল। আর এই বিশেষ মোটরসাইকেল মডেলগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল ও জনপ্রিয় একটি মোটরসাইকেল সিরিজ ও মডেল হলো Bajaj Pulsar 150 মডেলটি। সেইসূত্রে বাজাজ এদেশে অন্যতম সফল একটি নাম।
বাংলাদেশের বাজারে বাজাজ ও বাজাজ পালসারের সূচনা
বাজাজের Bajaj Pulsar 150 অত্যন্ত সফল একটি মোটরসাইকেল মডেল। এটির সাফল্যের ধারাবহিকতায় বাজাজ এদেশে একটি শক্ত অবস্থানে আসে। সময়ে সময়ে পালসার এর স্মল-ক্যাপাসিটির কয়েকটি মডেল বাজারে আসলেও সেগুলি 150cc মডেলটির মতো স্থায়ী হয়নি। বরং Pulsar LS135 অথবা Pulsar 125 মডেলগুলি কিছুকাল পরেই বাজারে আসা বন্ধ হয়ে গেছে।

Also Read: Motorcycle Price In Bangladesh
তবে মজার বিষয় হলো সেই পুরাতন Bajaj Pulsar 150 মডেলটি এখনো বাজারে সচল। Bajaj Pulsar 150 মডেলটি বাংলাদেশের বাজারে প্রথমবার আসে ২০০১ সালে। মূলত: সেই থেকেই এদেশে Bajaj Pulsar সিরিজের শুরু। এরপর বাজাজ এই মডেলটির উপর সময়ে সময়ে আরো নতুন কিছু ফিচার যোগ করে কিছুটা নতুনভাবে বাজারে নিয়ে আসে। তবে মূল মোটরসাইকেলটি এখনো আগের সেই আইডেনটিক্যাল ডিজাইনেই রয়ে গেছে।

তবে বিভিন্ন মাইনর আপডেট দেবার সাথে সাথে Bajaj Pulsar 150 মডেলটির ইঞ্জিনটিকে DTSi সমৃদ্ধ করা হয়, যা Pulsar এর ১৫০/১৮০/২০০সিসি মডেলগুলোর সাথে সাথে পরবর্তীতে তাদের RS/NS সিরিজ—পালসার লাইনআপেও যোগ করা হয়। তবে সবকিছুর উপরে বাংলাদেশে বাজাজের উপস্থিতি ও পালসারের জনপ্রিয়তা মূলত: ২০০১ সালের সেই সময়টা থেকেই বাড়তে থাকে। ফলে বাজাজ দ্রুতই স্থানীয় বাজারে একটা লক্ষণীয় অংশ দখলে নিতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের মোটরসাইকেল মার্কেটে বাজাজের সাম্প্রতিক অবস্থান
সাম্প্রতিক কিছু বাজার বিশ্লেষণে জানা যায়, বাংলাদেশে দুই-চাকার বাজারের আকার ২০২৪ সালে মোটামুটি USD1.4 বিলিয়ন বলে ধরা হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে সেটি আরো দ্রুত বর্ধনের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারে এখন প্রধানত ১০০–১২৫ সিসি কমিউটার সেগমেন্টের মোটরসাইকেল অনেক বেশি জনপ্রিয়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাজাজের মোট মার্কেট শেয়ার মোটামুটি ২০–২৩%। অর্থাৎ, বাজাজ এখনও এই সেগমেন্টে অন্যন্য ব্র্যান্ডের সাথে প্রতিযোগীতায় বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে অন্যান্য মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডগুলো সময়ে সময়ে তাদের নতুন নতুন মোটরমাইকেল মডেল লঞ্চ করেছে। সেই তুলনায় বাজাজ নি:সন্দেহে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
Also Read: Bajaj Motorcycle Price In Bangladesh
সাম্প্রতিক সময়ে বাজাজের জনপ্রিয়তা কি কমছে?
বাংলাদেশে বর্তমানে শহরায়ন ও সেইসাথে শহরে ও গ্রামে মানুষের দৈনন্দিন চলাচলের চাহিদায় স্মল-ক্যাপাসিটি ও জ্বালানি-সাশ্রয়ী ধরনের কমিউটার মোটরসাইকেলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এখনকার মোটরসাইকেলের ১০০–১২৫সিসির মডেলগুলো আধুনিক ফিচারযুক্ত হবার সাথে সাথে কমফোর্ট, ফুয়েল-ইকোনমি, ও মেইনটেন্যান্সে সুবিধাজনক হওয়ায় বেশিরভাগ ক্রেতা মূলত: সেদিকেই বেশি ঝুকছেন।
Also Read: Bajaj N250 Price In Bangladesh
ফলে অন্যান্য পুরাতন মডেলের ১৫০সিসির মোটরসাইকেলগুলোর মতো পালসারের ১৫০সিসি এবং তার উপরের সেগমেন্টের পুরাতন মোটরসাইকেলগুলোতে বাইকারদের আগ্রহ দ্রুত কমে যাচ্ছে। এছাড়াও এখনকার স্মল-ক্যাপাসিটি সেগমেন্টেই অন্যান্য গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলো আরো বেশি আধুনিক ও স্টাইলিশ মোটরসাইকেল বাংলাদেশের বাজারে লঞ্চ করে চলেছে। ফলে বাজাজের পালসার ১৫০ এর মতো পুরাতন মোটরসাইকেলগুলো স্বাভাবিকভাবেই বাজার হারাচ্ছে।
শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা (জাপানি ও চীনা ব্র্যান্ডগুলোর উন্নতি)
হোন্ডা, ইয়ামাহা, সুজুকির সাথে সাথে চায়নীজ মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডগুলো বর্তমান সময়ে আধুনিক ডিজাইন, নির্ভরযোগ্যতা, ও ভাল আফটারসেলস সার্ভিস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের গ্রাহক শক্তভাবে ধরে রেখেছে। এই ব্র্যান্ডগুলো তাদের কমিউটার সেগমেন্টেই অনেকবেশি ফিচার, কমফোর্ট ক্যারেক্টারিস্টিকস, এবং সেইসাথে কস্ট-এফিশিয়েন্ট প্রডাক্ট দিয়ে থাকে। অর্থাৎ কেবল পারফরম্যান্স নয়, ব্র্যান্ডগুলো এখন সার্বিক বিষয়ে আরো বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
ফলে গ্রাহকরা এখন সার্বিকভাবেই ভ্যালু-ফর-মানি প্রডাক্টের দিকেই বেশি মনোযোগী। সেইসূত্রে এখনকার সচেতন গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ব্র্যান্ডগুলো নতুন নতুন মোটরসাইকেল মডেলতো আনছেই, সাথে সাথে তাদের মোটরসাইকেলে ডিজাইনের বৈচিত্রের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিরও সমন্বয় ঘটছে। আর সার্বিকভাবে গ্রাহকমনে গ্লোবাল ব্র্যান্ডগুলোর ব্র্যান্ড-ভ্যালুর বাড়তি আবেদনতো রয়েছেই।
Also Read: Bajaj N160 Price In Bangladesh
বস্তুত এসবক্ষেত্রে বাজাজ পালসার ১৫০ এর মতো মডেলগুলো প্রতিযোগীতায় অনেকটাই পিছিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাজাজ বর্তমানে তাদের প্রডাক্টলাইনে বিশ্বমানের নতুন পালসার মডেলগুলো (NS/RS সিরিজ, ২৫০–৪০০ সিসির নতুন মডেল) যোগ করলেও স্থানীয়ভাবে (বাংলাদেশে) যে লাইন-আপ, ফিচার, ও দামের সমন্বয় পাওয়া যাচ্ছে তা প্রত্যাশিত গ্রাহকচাহিদা মেটাতে তেমনভাবে পারছে না; ফলে পিছিয়ে পড়ছে।
বাজাজের ডিজাইন ট্রেন্ড এবং স্টাইলে বৈচিত্রহীনতা
বাজাজের মোটরসাইকেল লাইনআপের একটি দুর্বল দিক হচ্ছে তাদের ডিজাইন ট্রেন্ড ও স্টাইলিংয়ে তেমন আমূল বৈচিত্র না থাকা। এমনকি তাদের নতুন মডেল গুলোতেও এখনো সেই পুরাতন আইডেনটিক্যাল ও রিপিটেটিভ ডিজাইন ধরে রাখার প্রবনতা রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, পালসার এন ১৬০ এবং ২৫০সিসির মডেলের ডিজাইন ও স্টাইল একই রকম। সেগমেন্ট ভেদে তাতে স্বকীয় এ্যাস্থেটিক বা তেমন বৈচিত্র দেখা যায় না।
এছাড়া বাজাজের অনেক মোটরসাইকেল মডেলই প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখনও অন্যান্য ব্র্যান্ডের অনেক মডেল থেকেই অনেকটা পিছিয়ে। সামগ্রিকভাবে তাদের মোটরসাইকেলে এখন এবিএস, ফুয়েল ইঞ্জেকশন, ব্লু-টুথ কনসোলসহ কিছু আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হলেও তাদের সার্ভিস, আফটারসেলস স্পেয়ার, ও মেইনটেন্যান্স সাপোর্টও অত্যন্ত দুর্বল ও পুরাতন ধাঁচের।
আর অনেক ব্যবহারকারীই মনে করেন বাজাজের ডিজাইন ও রাইডিং কমফোর্টে অনেকটাই উন্নতি প্রয়োজন। অপরদিকে ১২৫-১৫০সিসি ক্যাটাগরীতেও তাদের মডেলগুলোতে সেভাবে নতুন প্রযুক্তির সংযোজন বা ডিজাইনের তেমন পরিবর্তন আসেনি। সুতরাং অনেক বাইকারই এখনো বাজাজ বা পালসার সিরিজের ভক্ত হলেও তাতে বাস্তবিক আপলিফট না থাকায় নতুনভাবে অনেকেই তাদের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে না।
পরিশেষে সবমিলিয়ে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের বাজারে বাজাজ পালসার সিরিজের একসময়কার চমৎকার সময় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকলেও ইতিমধ্যেই গ্রাহক চাহিদার গ্রাফিক্যাল লাইন নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এখন সময় ও গ্রাহক চাহিদা দ্রুত বদলাচ্ছে। সেই প্রেক্ষিতে আধুনিক ডিজাইন, এ্যাডভান্স ফিচার, নিবেদিত আফটারসেলস সার্ভিস প্রভুতির সুসমন্বয় ঘটালে হয়তো বাজাজ ও পালসার সিরিজের সেই সময় আবারো ফিরে আসবে।
