Dayang Runner Deluxe নিয়ে মালিকানা রিভিউ লিখেছেন মাহবুব আলম
This page was last updated on 18-Aug-2024 10:46am , By Shuvo Bangla
একটি মোটরবাইক ঠিক কতো কিমি পর্যন্ত চালালে এর বিষয়ে ভালো-মন্দ যাচাই করা সম্ভব? ১৩ মাসে ১৪০০০ কি,মি চালিয়ে Dayang Runner Deluxe নামের এই ছোট্ট বাইকটির বিষয়ে লিখতে বসলাম। আমার বাইক চালাবার অভিজ্ঞতা শুধু মাত্র এই ১৩টি মাসই। তাই যদি কোন প্রকার ভুল ত্রুটি ও অহেতুক কিছু মনে হয়, তাহলে অনুগ্রহ পূর্বক ভুলটি কমেন্ট এর মাধ্যমে সংশোধন করে দিলে খুশি হবো । আর রিভিউ টি একটু বিস্তারিত হবার ফলশ্রুতিতে বড় হয়ে গেছে, কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত পড়লে এই বাইকটি নিয়ে একটি ধারনা পাবেন।
Dayang Runner Deluxe নিয়ে মালিকানা রিভিউ লিখেছেন মাহবুব আলম
বাইক কেনার আসলে আমার স্বপ্ন বা ইচ্ছা কোনটিই কখনো ছিল না, এইতো সেদিনের কথা আমি সাইকেল চালাতাম, বাসা ধানমন্ডি থেকে অফিস গুলশানে সাইকেল চালিয়েই যেতাম। হঠাত একদিন ভাবলাম, একটু বেশিই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ১টা ছোটখাটো চলার মতো মটরসাইকেল কিনতে পারি! আমি মানুষ হিসেবে একটু বেশিই খাটো, তাই বাইক কেনার এবং সিলেক্ট করার চিন্তাটা ছিল গভীর, অপরদিকে ক্যাশ টাকাও অতোটা পকেটে ছিলো না।
তারপর ও সাহস করে এক শোরুম থেকে আরেক শোরুমে ঘুরতে থাকলাম, মূল সমস্যায় পড়েছিলাম কি বাইক কিনবো/কোন কম্পানির বাইক কিনবো? একপর্যায়ে বাইক বিডি তে জয়েন করলাম, আরো কিছু বাইকিং কমিউনিটি তে জয়েন্ট করলাম, তার ভেতর "রানার বাইকার্স ক্লাব" অন্যতম।
৯ ই মে ২০১৬ তে রানারের তেজগাঁও শোরুমে গেলাম, এবং জানতে পারলাম তাদের নতুন কিস্তি সুবিধা চালু হয়েছে। সাথে সাথে আর এদিক ওদিক না ভেবে ১০০ টাকা দিয়ে একটি ফর্ম নিয়ে ও ডিলাক্স এর ১টি ব্রশিয়ার নিয়ে বাসায় চলে এলাম, এবার শুরু হলো বাসা থেকে বোন আর দুলাভাই এর লেকচার, বাবা-মা পৃথিবীতে না থাকার কারনে তারাই আমার অভিভাবক। অনেক আকুতি মিনতি করার পর বোন কে রাজি করালাম, সে-ই দুলাভাই কে রাজি করালো!
রাজী হবার পর দিনই ফিলাপ করা ফর্ম জমা দিয়ে দিলাম, রানার আমার ভেরিফিকেশন শেষ করে আমাকে কল দিয়ে জানালো বাইক নিয়ে আসতে, তার পরই চলে গেলাম ১৫ই মে ২০১৬ তে। কিস্তিতে কেনার জন্য যে সকল প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র জমা দিয়েছিলাম, সেগুলো হলো- * ফিলাপ করা ফর্ম * আমার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি * ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি * ২ জন গ্যারান্টার (আমার দুলাভাই+অফিস কলিগ) এর ভোটার আইডি কার্ড এর ফটোকপি * ২ জনেরই ছবি * সকলের কর্ম স্থলের ডকুমেন্ট * ৩০০ টাকার ষ্টাম্প (কিস্তি চুক্তির জন্য) * ১২ মাসের ইন্সটলমেন্ট এর জন্য ১২ টি চেক এর পাতা * সবশেষে ২ জন গ্যারান্টার কে সশরীরে নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম তেজগাঁও শোরুমে। (তবে জেনে রাখুন, কিস্তিতে বাইক কিনলে কিন্তু রেজিষ্ট্রেশন রানারের নামেই হয়, পরবর্তিতে কিস্তি শেষ হয়ে গেলে, রানার আপনাকে ক্লিয়ারেন্স এর ফাইল দিয়ে দিবে, আপনি সেটা নিয়ে বি,আর,টি,এ তে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে নাম পরিবর্তন করে নিতে পারবেন।) এরপর তারা আমাকে গোডাউনে নিয়ে গিয়ে বাইক চয়েজ করতে বললো, আমি বাইকের কিছুই বুঝতাম না, শুধু ইঞ্জিন নাম্বার ও চেসিস নাম্বার চেক করে ষ্টার্ট দিয়ে দেখালো, আমিও তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে গেলাম। আমাকে বাইক বুঝিয়ে দেওয়ার আগে তাদের কে বললাম, আমি বাইক চালাতে জানিনা, আমার জন্য সিট এর হাইট টা একটু বেশিই ছিল, নামিয়ে দিতে বললাম, তারা সব কমপ্লিট করে আমাকে চাবী বুঝিয়ে দিল, আমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম বাইক কিভাবে চালায়? তাদের দেওয়া ইন্সট্রাকশনে ২/৩ বারের চেষ্টায় বাইক ধাক্কা মেরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ৪র্থ বারে চালাতে পারলাম, ২০ মিনিট নাবিস্কোর পিছনের খোলা রাস্তায় প্রেক্টিস করে বাইক চালিয়ে নিজেই চলে আসলাম ধানমন্ডি। সাইকেল চালাতে পারতাম বলে নিজের ভেতরে একটা কনফিডেন্ট কাজ করছিলো, তাই সহজেই পেরে গেছি।
কেনো রানার ডিলাক্স চয়েজ করলাম?
প্রথমত, আমার ছোট আকারের কম সিসির বাইক প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, আমি কিস্তিতে কিনতে চেয়েছিলাম, তাই রানার নেওয়া। তৃতীয়ত, আমি আগে থেকে বাইক চালাতে পারতাম না। চতুর্থত, আমার রাফ ইউজ করা দরকার ছিলো। পঞ্চমত, ভালো মাইলেজ দরকার ছিলো। ষষ্ঠত, বাইকটিতে কিকের পাশাপাশি সেল্ফ ষ্টার্ট ও আছে।
Dayang Runner Deluxe এর প্রাইজ
আমি ২০১৬ সালে কিনেছিলাম ১ বছরের কিস্তিতে ৯৩০১৪ টাকায় সাথে ১১৭০০ টাকা বি,আর,টি,এ এর রেজিষ্ট্রেশনের জন্য জমা দিয়েছিলাম এই কিস্তি এমাউন্ট এর বাহিরে। বর্তমানে এই বাইকটির নগদ মূল্য হলো ৮৩০০০ হাজার টাকা। আমার সর্বমোট খরচ (৯৩০১৪+১১৭০০+৩০০+১০০) = ১০৫১১৪
টাকা।
এবার আসি বাইকের পার্ফরমেন্স নিয়ে-
আমি ইঞ্জিনের ব্রেকইন পিরিয়ডটি খুব সাবধানে যত্নের সাথে শেষ করেছিলাম, প্রথম ৪০০ কি,মি এই মবিল চেঞ্জ ও সার্ভিস করেছিলাম, ২য় বার মবিল চেঞ্জ করেছিলাম ১০০০ কিমি এ, এবং ৩য় বার করেছিলাম ১৮০০ কি,মি এ। এরপর প্রতি ১০০০ কি,মি পরপর মবিল ড্রেন করে দেই। বাইকটি মূলত ৮৫ সিসি, এর সম্পূর্ন স্পেসিফিকেশন আপনারা নিচের এই লিংক টি থেকে দেখতে পারবেন।
সিসি হিসেবে এই ছোট্ট বাইক টির টপ স্পিড কিন্তু অবিশ্বাষ্য! আমি রানার বাইকার্স ক্লাবের সাথে কুমিল্লা ট্যুরের সময় ৯৫+ স্পিড তুলতে সক্ষম হয়েছি, ৯৯% মানুষ আমার এই কথাটি বিশ্বাস করতে চাইবে না, কিন্তু সাক্ষী প্রমান ও কিন্তু এই গ্রুপের ভাইরাই আছেন, প্রয়োজন হলে বলবেন, আমি মেনশন করবো। যদিও টপ স্পিড নিয়ে লাফালাফি অথবা খেলা করার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিলনা, আমি সেফটি ভালোবাসি। তবে রেগুলারলি ৮০-৮৫ খুব স্মুথ ভাবেই স্পিড উঠে যায়। একটি চায়না কোম্পানীর ইঞ্জিন হিসেবে, এই বাইকটি থেকে আমি চমৎকার সাপোর্ট পাচ্ছি, ১৩ মাসে এখন পর্যন্ত ১৪০০০+ কি,মি চালিয়েছি, কিন্তু কখনো কোনদিনও ইঞ্জিনে টাচ করতে হয়নি।
এবার আসি মাইলেজ নিয়ে, এক কথায় Dayang Runner Deluxe বাইকটি আপনার রাফ ইউজের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে, আপনি ঢাকার ভেতরে যানজট কে উপেক্ষা করে রাফ ইউজ করতে পারবেন আরামে, কারন এই বাইকটির মাইলেজ পেট্রোল প্রতি লিটারে ৬২-৬৫ কিমি পর্যন্ত পাই রেগুলারলি। ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ৪৬২ কি,মি চালিয়েছি ফুল এক টাংকি পেট্রোলে, যদিও তেল কিন্তু এখনো আছে। এই বাইকটিতে তেল ধরে সর্বমোট ৯ লিটার, যার ভেতর রিজার্ভ ১ লিটার বাদ দিলে ৮ লিটার। একবার ফুল টাংকি তেল নিলে ৪৯৫-৫১০ কিমি পর্যন্ত চালাতে পারি ঢাকার ভেতরে। আর লং এ যখন যাই তখন লিটারে ৭০+ ও পেয়েছি। এই ছোট্ট বাহনটি নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেকবার লং ট্যুরে গিয়েছি, কুমিল্লা, নোয়াখালি, লক্ষীপুর, রায়পুর, লাকসাম, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, টাংগাইল, গাজীপুর, আশুলিয়া, ময়মংসিংহ, বরিশাল। লং রোড এ এই সকল জেলায় গিয়েছি।
বাইকের সুরক্ষায় আমি যা করিঃ
এতোটা রাফ ইউজ করার পরো, এখনো ইঞ্জিন সাউন্ড সম্পুর্ণ স্মুথ, কারন বাইকের সুরক্ষায় আমি যা করি তা হলো- প্রতি ২ সপ্তাহ অন্তর অন্তর বাইক কে ওয়াশ করানো, ১০০০ কি,মি পর পর নিয়মিত মবিল পরিবর্তন, রেগুলার ব্যাসিসে সার্ভিস করানো। মবিল ব্যবহার করি কিক্স আল্ট্রা 4T 20W50. তাছাড়া, সার্ভিস করাতে আমাকে এখন পর্যন্ত কোন বড় ধড়নের টেনশন পোহাতে হয়নি। আজ পর্যন্ত প্রাইমারী সমস্যা গুলো ছাড়া যেমন- (ব্রেক চেকিং, ব্যাটারী চার্জিং, চেন টাইট, লুব্রিকেটিং) আর কোন বড় ধরনের ঝামেলার সম্মুখীন হইনি।
এবার আসি, আমি যেই সমস্যাগুলো বেশি ফেইস করি-
বাইকটির ওজন খুবই পাতলা, মাত্র ৮৮ কেজি, যার ফলে বাতাস থাকলে অনেক ধক্কি ধকল পোহাতে হয়, সে সময় আস্তে এবং খুব সাবধানে চালাতে হয়। ব্রেক ফ্রন্ট এবং রিয়ার ২টিই ড্রাম হওয়ায়, ব্রেকিং সিস্টেম লং রোডের জন্য অনেক দূর্বল, যার ফলে খুব বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বৃষ্টির ভেতরে ভিজলে ২ টি ব্রেক ই মারাত্বক হার্ড হয়ে যায়। যার ফলে নাস্তানাবুদ হয়েছি অনেক বার।
Dayang Runner Deluxe এর শক এবজরবার অত্যন্ত হার্ড হওয়ায়, বাইকটিতে ঝাকি টের পাওয়া যায় ভালোই, সামনের সাসপেনশনও ও খুব যে ভালো খেলে তা না। তবে আমি মানিয়ে নিয়েছি। ফুয়েল মিটার না থাকার কারনে, তেল কতটুকু আছে তা দেখবার কোন উপায় নাই। চাকা গুলো তুলনা মূলক ছোট, ১৭ রিমের উপর ২.৭৫ রিয়ার টায়ার এবং ২.৫ ফ্রন্ট টায়ার, যা আমাকে হালকা বালুযুক্ত রাস্তায় বেশ ভোগান্তিতে ফেলে, ব্রেক হালকা ভাবে করলেও মাঝে মাঝে স্লিপ করে বসে, হয়তো এটা আমার ব্রেকিং এর এডজাস্টমেন্ট এর কারনেও হতে পারে।
২ বার এক্সিডেন্ট ও করেছি, তবে সেটা যৎসামান্যই ছিলো, একবার পানিতে স্কিড করে, অপরবার তৈলাক্ত রাস্তায় স্কিড করে.! ক্ষতি হয়েছিল খুবই সামান্য, একবার ৭ দিনের রেষ্ট, আরেকবার কিছুই হয়নি। এখন পর্যন্ত বেশ কিছু পার্টস ও চেঞ্জ করেছি, কিছুটা মডিফাই করার চেষ্টা নিয়ে এফ,জেড এর হ্যান্ডেল বার কেটে মডিফাই করে লাগিয়েছি, ব্যাটারী পরিবর্তন করে রহিম আফরোজ এর গ্লোবাট ড্রাইসেল ৬ এম্পিয়ার লাগিয়েছি, ষ্টক ব্যাটারীটা ছিলো ৫ এম্পিয়ার।
ষ্টক ব্যাটারী টা একটু তাড়াতাড়িই বসে গেছে, হয়তো এটা আমার প্রথম অবস্থায় ব্যাবহার ভুলের কারনে। যাই হোক, এখন শেষ করতে হবে, অনেক বড় হয়ে গেছে ইতিহাস, আপনাদের সাথে শেয়ার করার উদ্যেশ্য হলো- যারা স্বল্প আয়ের অল্প টাকায় ভালো কিছু পেতে চান, তারা এই ৮৫ সিসি ডিলাক্স বাইকটা কিনতে পারেন। তবে এই পোষ্ট তাদের জন্য নয়, যারা টপ স্পিড পছন্দ করেন, রেডি পিকাপ পছন্দ করেন, ভালো লুক পছন্দ করেন! বড়ং এই পোষ্ট টি তাদের ই জন্য, যারা আমার মতো চাকুরীরত, যাদের নিত্য দিনের যাতায়াতের পেছনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় রাস্তায় নষ্ট করতে হচ্ছে, যারা কম মূল্যে প্রয়োজনের তাগিদে বাইক কিনতে চান, তারা অবশ্যই একবার রানারের সৌরূমে ঢু মেরে দেখে আসতে পারেন।
রানার বাংলাদেশে দিন বাই দিন ভালোই করছে, তারা পন্যের গুনগত মানের দিকে মোটামুটি ভাবে সচেতন। তাদের বাইক গুলো বেশ ভালোই করেছে, তবে তাদের পার্টস এর দাম বেশি এবং সার্ভিস সেন্টারে অনেক চাপ, যার ফলে মেকানিক দের ব্যাবহার তথা কাজের মান অত্যন্ত নিম্ন মানের হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি বলবো যদি আপনি কিস্তি সুবিধার ভেতর কম মূল্যে ভালো কিছু আশা করেন, তবে অবশ্যই রানারের বাইক কিনতে ভুল করবেন না।
সকলকে ধন্যবাদ জানাই, আমার এই Dayang Runner Deluxe রিভিউটি চোখ বুলিয়ে দেখার জন্য, আমি আশা করি আমার মতো মধ্যবিত্ত চাকুরীরত মানুষ অন্তত একটি চলার মতো ভালো একটি বাইকের ব্যাপারে ধারনা পেলেন। সকলে ভালো থাকবেন, অবশ্যই বাইক চালাতে হেলমেট পরিধান করবেন। মনে রাখবেন, সময় এবং ফ্যাশনের চেয়ে কিন্তু জীবন হাজার গুন বেশী মুল্যবান। ধন্যবাদ, মাহবুব আলম।