বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি বাইক
This page was last updated on 02-Jul-2025 11:11am , By Badhan Roy
বাংলাদেশের মাটিতে মূলত: ৮০ এর দশক থেকেই মোটরসাইকেল ব্যাবহার বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে যাতায়াতের প্রয়োজনকে ছাপিয়ে শখের ও লাইফস্টাইলের অংশ হিসেবে দেশের বাইকাররা মোটরসাইকেলকে আপন করে নিতে শুরু করে। আর সময়ের সাথে সাথে এখনকার মোটরসাইকেলের প্রযুক্তিগত এবং গঠনগত অনেক উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি বাইক
তবে এতোকিছুর পরেও আগের দিনের কিছু কিছু বাইক মানুষের মনে এখনো গেঁথে আছে, তার মধ্যে অনেক বাইক এখনো কিছু সৌখিন বাইকারদের কাছে পরম যত্নে সংগৃহিত আছে। এখনো অনেকেই বর্তমান যুগের বাইকগুলোর সাথে সেই লেজেন্ডারি বাইকগুলোর বিল্ড কোয়ালিটি, লুক এবং পারফর্মেন্স নিয়ে তুলনা করে থাকেন। তেমনই বেশ কিছু বাইকের স্মৃতিচারণ এই আর্টিকেলে করা হয়েছে।

Yamaha RX 100
২-স্ট্রোক বাইকের কথা বলতে গেলেই Yamaha RX100 বাইকের নাম সর্বপ্রথম মাথায় আসে। ১৯৮৫ সালের আশপাশে জাপানে এবং ভারতে এই বাইকগুলোর উৎপাদন শুরু হয়। এই বাইকগুলোর বিল্ড কোয়ালিটি কেমন ছিল তা বর্তমান সময়ে যে বাইকগুলো সচল আছে তা দেখলেই আন্দাজ পাওয়া যায়।
৯৮.২ সিসি, সিঙ্গেল সিলিন্ডার, টু-স্ট্রোক, এয়ার-কুলড ইঞ্জিনের পাওয়ার আউটপুট ছিল ১১.২ বিএইচপি @ ৭৫০০ আরপিএম এবং টর্ক ছিল ১০.৪৫ এনএম @ ৭৫০০ আরপিএম। সাথে এক্সপেনশন চেম্বার , হেড পোর্টিং , টিউনড ২ স্ট্রোক ইঞ্জিন, তুলনামূলক বড় কার্বরেটর, এয়ার ফিল্টার, ইনিশিয়াল থ্রোটল, ও তৎকালীন সময়ের শক্তিশালী সিডিআই এবং সব মিলিয়ে পাওয়ার টু ওয়েট রেশিও বাইকগুলো কে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

পরবর্তিতে সাক্সেসর হিসেবে ইয়ামাহা এর RX115 ও RX135 বাজারে আসে ডিস্ক ব্রেক, অতিরিক্ত ফিফথ গিয়ার, রেস পিস্টন, রেসিং CDI সিস্টেম এর মত আপগ্রেড নিয়ে এবং সমান সাড়া ফেলে। এখনো পর্যন্ত এইসকল মডেলের অনেক বাইক সচল আছে যেগুলোর বয়স প্রায় ৩০-৩৫ বছর এবং সেগুলো বর্তমান সময়ের যে কোন বাইকের চেয়ে ভাল বিল্ড কোয়ালিটি এবং পারফর্মেন্স নিয়ে গর্জনের সাথে রাস্তায় চলাচল করে।
Bajaj Discover 135
বর্তমানে ১১০-১২৫ সিসি কম্যুটার সেগমেন্টে অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত, অন্যতম সেরা এবং রিলায়েবল বাইক মডেল বাজাজ ডিসকভার সিরিজ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ডিসকভার সিরিজের এই জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে লেজেন্ডারি ডিসকভার ১৩৫ মডেল টি দিয়ে। ১৩৪.২১ সিসি, ৪-স্ট্রোক, সিঙ্গেল সিলিন্ডার, এয়ার-কুলড DTS-i ইঞ্জিনটির সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল ১৩.১০ হর্সপাওয়ার ৮৫০০ rpm এ এবং সর্বোচ্চ টর্ক ছিল ১১.৮৮ Nm ৬৫০০ rpm এ।
১৩৩ কেজি ওজনের বাইকটির বিল্ড কোয়ালিটি এবং ওয়েট ব্যালান্সিং ছিল চমৎকার। সেই সময় ডিসকভার মডেলের বাইকটির ডিস্ক ভেরিয়েন্ট টি ছিল অন্যতম সেরা ব্রেকিং ও কন্ট্রোলিং এর একটি বাইক যার টপ স্পিড ও ছিল ১০০ এর উপরে। জ্বালানী সাশ্রয়ী, শক্তিশালি ইঞ্জিন এবং লো মেইন্টেইনেন্স এর এই চমৎকার ব্যালান্সড কম্যুটার বাইকটি তরুণ থেকে বৃদ্ধ সবার সাথে মানানসই ছিল। এই বাইকটির প্রোডাকশন হটাৎ করে ২০১০ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
এই বাইকটির প্রোডাকশন বন্ধ হওয়ার মূল কারণ সঠিকভাবে নিশ্চিত না হওয়া গেলেও অনেকের ধারণা বাজারের নতুন প্রযুক্তির ১৫০ সিসির বাইকগুলো বিশেষ করে পালসারের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও বিক্রয় বৃদ্ধি এবং ডিসকভার সিরিজের ১০০-১২৫ সিসি সিরিজের উন্নতির দিকে বেশি গুরুত্ব প্রদানের লক্ষ্যে বাজাজ বাইকটির প্রোডাকশন বন্ধ করে দেয়। আজও অনেকের কাছে ডিসকভার ১৩৫ মডেলটি আবেগের নাম। অনেকের কাছেই এখনো কিছু ইউনিট সচল আছে এবং সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটপ্লেস গুলোতে অনেকেই এখনো এই লেজেন্ডারি ডিসকভার ১৩৫ মডেলের বাইকটি বেশ চড়া দামে ক্রয় বা বিক্রয় করতে চান।
Yamaha Fz-s V1
Lord of the streets খ্যাত Yamaha Fz-s বাইকটি ২০০৮ সালে প্রথম বাজারে আসে এবং এটি বাংলাদেশের বাইকপ্রেমীদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর স্টাইলিশ ডিজাইন, মাসকুলার বডি শেপ, পাওয়ারফুল পারফরম্যান্স এবং ব্রেকিং একে একটি আদর্শ স্ট্রিট বাইক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই বাইকটি বাইকপ্রেমিদের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারন ছিল এর মাসকুলার শেপের সাথে ওয়াইড টায়ার।
তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের বাজারে অফিশিয়ালি এটিই মোটা চাকার বাইক হিসেবে মার্কেটে ভাল সাড়া পেয়েছিল। ১৫৩ সিসি, এয়ার-কুলড, ৪-স্ট্রোক, SOHC, ২-ভাল্ভ ইঞ্জিনের বাইকটি ১৩.৮ বিএইচপি পাওয়ার @ ৭৫০০ আরপিএম এবং ১৩.৬ এনএম টর্ক @ ৬০০০ আরপিএম এ উৎপন্ন করতে পারতো। যদিও বাইকটির মাইলেজ কিছুটা কম ছিল সেগমেন্টের অন্যান্য বাইকগুলোর তুলনায় তারপরেও বাইকটির পাওয়ার, ব্রেকিং এবং লুকের জন্য বাইকটি অন্য মাত্রার জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
যদিও পরবর্তি সময়ে FZ-s সিরিজের আপগ্রেডে মাইলেজ, কমফোর্ট আর ব্রেকিং এর ক্রমাগত আপডেট আসলেও ইঞ্জিনের পাওয়ার ডেলিভারি কমে যাওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলে আসছে, তারপরেও এখনো রাস্তায় প্রচুর fzs-v1 মডেলের বাইক চলাচল করতে দেখা যায় এবং নতুন পাওয়া না গেলেও অল্প দামে পুরাতন বাইকগুলোর বেশ ভাল চাহিদা আছে।
Hero Honda CBz xtreme
হিরো হোন্ডা CBZ এক্সট্রিম (Hero Honda CBZ Xtreme) মোটরসাইকেলটি ২০০৬ সালে বাজারে আসে। ২০১০ সালে হিরো ও হোন্ডা যৌথ উদ্যোগের সমাপ্তির পর CBZ এক্সট্রিম মডেলটির উৎপাদন ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। এই মডেলটি হিরো হোন্ডা ব্র্যান্ডের অন্যতম একটি সফল মডেল ছিল।
১৪৯.২ সিসি, এয়ার-কুলড, ৪-স্ট্রোক, সিঙ্গেল সিলিন্ডার, OHC ইঞ্জিনটি ১৪.৪ বিএইচপি পাওয়ার @ ৮৫০০ rpm এবং ১২.৮ Nm টর্ক @ ৬৫০০ rpm উৎপন্ন করতে পারতো। ১৫০ সিসি সেগমেন্টে অন্যতম সেরা ইঞ্জিন ও তৎকালিন সময়ের আধুনিক কম্প্যাক্ট ডিজাইন তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বর্তমানে বাইকটি খুব একটা দেখা না গেলেও এখনো অনেক বাইকারের স্মৃতিতে বাইকটির পারফর্মেন্স এবং বিল্ড কোয়ালিটি গেথে আছে।
Honda CB Trigger 150
অনেকেরই ভারতীয় বাংলা সিনেমা “বরবাদ” এর কথা মনে আছে হয়তো। সিনেমার পুরো কাহিনী ছিল এই Honda CB Trigger 150 মডেলের বাইকটিকে কেন্দ্র করে। এই সিনেমাটি তখনকার তরুণ প্রজন্মের প্রতি বাইকটি সম্পর্কে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। শুধুমাত্র সিনেমাতে দেখেই না, বাইকটির বিল্ড কোয়ালিটি, পারফর্মেন্স, ব্রেকিং, কমফোর্টেবল সিট, ডিজিটাল মিটার সহ হোন্ডার রিলায়বিলিটি তরুণ প্রজন্ম ছাড়াও সব বয়সী মানুষের পছন্দের অন্যতম শীর্ষে উঠে যায়।
১৪৯.১ সিসি, ৪-স্ট্রোক, এয়ার-কুলড, OHC, সিঙ্গেল সিলিন্ডার ইঞ্জিনের বাইকটি ১৪.৩৫ বিএইচপি পাওয়ার @ ৮৫০০ আরপিএম এবং ১২.৫ এনএম টর্ক @ ৬৫০০ আরপিএম উৎপন্ন করতে পারতো। Honda India ২০১৮ সালে বাইকটির প্রোডাকশন বন্ধ করে দেয়। সফল এই মডেলটির প্রোডাকশন বন্ধ করার কারন ছিল তাদের নতুন BS-IV প্রযুক্তির উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করা।
এর ফলে Hornet সিরিজটি তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে Hornet সিরিজটি বেশ জনপ্রিয় এবং সফলভাবে এখনো মার্কেটে সেগমেন্টের অন্যতম শক্ত প্রতিদ্বন্দি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে ক্রমাগত আপডেটের সাথে। তারপরেও প্রচুর মানুষ CB trigger মডেলটিকে এখনো স্মরণ করে এবং এক সময়ে অনেক পরিমাণ সেল হওয়ার কারনে এখনো এই মডেলটির স্পেয়ার পার্টস এর এভেইলেবিলিটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে।
আমরা জানি, এরকম আরো অনেক চমৎকার এবং জনপ্রিয় বাইক একসময় বাংলাদেশের রাস্তা কাপিয়ে এক প্রকার “লেজেন্ডারি” হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। সব হয়তোবা একটি লেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কমেন্টে অবশ্যই জানাতে পারেন কোন বাইকটি আপনার পছন্দের এবং কোন কোন জনপ্রিয় বাইকগুলো উল্লেখ করে এই আর্টিকেলের আরেকটি পর্ব আকারে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা যায় কি না।
বাইক বিষয়ক সকল তথ্যের জন্য বাইকবিডির সাথেই থাকুন।
